Latest News

বাংলার ইসলাম ধর্মালম্বির (মুসলিমদের) অতীত ঐতিহ্য :

 



বাংলার ইসলাম ধর্মালম্বির (মুসলিমদের) অতীত ঐতিহ্য :


মুসলমানের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়  :

বাঙলার মুসলমানদের তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে। যথা

. আগন্তুক মুসলমান।

. ধর্মান্তরিত মুসলমান।

. উভয়ের মধ্যে সংমিশ্রিত মুসলমান

 

প্রথম শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে বাঙলার মুসলমান শাসকগণ পাঠান সুলতানগণ কর্তৃক রাজ্যের উচ্চপদসমূহে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য আনীত বিদেশী মুসলমানগণের বংশধরগণ দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে যারা স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল বা যাদের বলপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল, তাদের বংশধরগণ। তৃতীয় শ্রেণী হচ্ছে উপরি-উক্ত দুই শ্রেণীর সংমিশ্রণে উৎপন্ন মুসলমানগণের বংশধরগণ। এদের মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণীর সংখ্যাই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।

বাঙলায় মুসলমানসমাজ প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙলা মুসলমানগণ কর্তৃক বিজিত হবার পর। ১২০৪ খ্রীষ্টাব্দে বখতিয়ার খিলজি প্রথম বাঙলা জয় করার সময় থেকে শুরু করে ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দে ইংরাজ কর্তৃক দেওয়ানি গ্রহণের সময় পর্যন্ত এই সার্ধ পাঁচশত বৎসর বাঙলা মুসলমানগণের অধীনে থাকে। আগন্তুক মুসলমানই বলুন, আর ধর্মান্তরিত মুসলমানই বলুন, আর এই দুইয়ের সংমিশ্রণে উৎপন্ন মুসলমানই বলুন, তাদের সকলেরই উদ্ভব হয়েছিল এই সার্ধ পাঁচশ বছরের মধ্যে। তবে এর পর যে কেউ মুসলমান হয়নি, এমন কথাও সত্য নয়। এর পরও হিন্দু মুসলমান হয়েছে, তবে তাদের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। সেরূপ মুসলমানরা সকলেই দেশজ মুসলমান।

বর্তমান শতাব্দীর প্রারম্ভে ১৯০১ খ্রীষ্টাব্দে গৃহীত আদমশুমারির সময় মুসলমানরা দাবি করেছিল যে তারা দেশজ-সম্প্রদায় নয়, তারা সকলেই বাঙলায় আগন্তুক মুসলমানদের বংশধর। বিশিষ্ট নৃতত্ত্ববিদ্প্রয়াত . অতুল সুর মহাশয়ের 'বাঙলা বাঙালীর বিবর্তন'  ১৯৮৬  গ্রন্থ থেকে তাঁর পুত্র বিশিষ্ট আইনজীবী শ্রীযুক্ত বদ্রীনারায়ণ সুর মহাশয়ের দলিল হতে অনুমতি  ক্রমে সংগ্রহ  'সাহিত্যলোক' প্রকাশনা সংস্থার অধিকর্তা শ্রীযুক্ত নেপালচন্দ্র ঘোষ মহাশয় তথ্যটি প্রকাশ করেন । আমরা উভয়ের কাছেই কৃতজ্ঞ। এখানে ভাষা বানান অবিকৃত রাখা হয়েছে।

তারা সকলেই সৈয়দ, মুঘল আফগান শাসকমণ্ডলীর বংশধর। সে দাবিটা যে সম্পূর্ণ অমূলক, তা তৎকালীন আদমশুমারির কমিশনার . . গেট [E. A. Gait] প্রমাণ করেন। তিনি বলেন যে, যে-সকল রাজকীয় মুসলমান কর্মচারীদের এদেশে আনা হয়েছিল তারা তৎকালীন রাজধানীসমূহ যথা গৌড়, পাণ্ডুয়া, রাজমহল, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি শহরের নিকট এসে বসবাস করেছিল। তারা তৎকালীন সুলতান নবাবদের কাছ থেকে বসবাসের জন্য ভূমিদানও পেয়েছিল। সেই সকল ভূমিদান সংক্রান্ত দলিলাদি পরীক্ষা করলে দেখা যাবে যে ওই সকল ভূমি প্রাপকেরা গৌড়, পাণ্ডুয়া মুর্শিদাবাদের নিকটেই পেয়েছিল। কিন্তু বাঙলার মুসলমান জনসংখ্যার বিন্যাস দেখলে দেখতে পাওয়া যাবে যে যদিও এরূপ ভূমিদান সংক্রান্ত দলিলাদি উত্তর পূর্ববঙ্গে খুবই কম, তথাপি বাঙলার এই দুই অংশেই মুসলমানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

উত্তরবঙ্গের পরিস্থিতিটা বুকানন হ্যামিলটনও [Buchanan Hamilton] লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে উত্তরবঙ্গের মুসলমানরা যে বাঙলায় আগন্তুক মুসলমানগণের বংশধর, এরূপ বিবেচনা করবার সপক্ষে বিশেষ কিছু প্রমাণ নেই। তিনি বলেছিলেন যে, তারা ধর্মান্তরিত দেশজ মুসলমান ছাড়া কিছুই নয়। পরবর্তীকালে একজন মুসলমান লেখকও এই উক্তিরই প্রতিধ্বনি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন—'আমি প্রায়ই লক্ষ্য করেছি যে, উত্তরবঙ্গের মুসলমানরা মঙ্গোলীয় কোচ জাতির দৈহিক লক্ষণসমূহ বহন করে।' তার মানে তারা ধর্মান্তরিত কোচ [বর্তমানে রাজবংশী] জাতি হতে উদ্ভূত। পূর্ববঙ্গের মুসলমানরাও যে ধর্মান্তরিত দেশজ হিন্দুজাতিসমূহ হতে উদ্ভূত, তা ১৮৯৪ খ্রীষ্টাব্দে ডঃ ওয়াইজ- [Dr. Wise] বলেছিলেন।

বস্তুতঃ চতুর্দশ শতাব্দীতে কিছুকালের জন্য মুসলমান সুলতানরা পূর্ববঙ্গের সোনারগাঁ হতে রাজত্ব করেছিলেন। তাঁরা পীর, দরবেশ মোল্লা নিযুক্ত করে পূর্ববঙ্গের নিম্নশ্রেণীর হিন্দুদের পাইকারি হারে ধর্মান্তরিত করেছিলেন। পঞ্চদশ শতাব্দীতে সুলতান জালালুদ্দিনের সময় [১৪১৮-১৪৩৩] এই ধর্মান্তরিত করার অভিযান তুঙ্গে উঠেছিল। দুর্বল নিম্নসম্প্রদায় হিন্দুদের কাছে দুটি প্রস্তাব রাখা হয়েছিল—'হয় কোরান গ্রহণ কর, আর তা নয়ত মৃত্যুবরণ কর।' প্রাণভয়ে অনেকেই মুসলমান হয়ে গিয়েছিল। যারা অস্বীকৃত হয়েছিল, তারা কামরূপ, আসাম কাছাড়ের জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। ধর্মান্তরিতকরণ সম্বন্ধে বার্নিয়ার [ Bernier) তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে এক কাহিনীর উল্লেখ করে গিয়েছেন। ধর্মান্তরিত মুসলমানদের নিশানা ছিল, ঘরের চালের উপর একটা 'বদনা' বসিয়ে রাখা। একবার এক মৌলবি কিছুদিনের জন্য দেশান্তরে গিয়েছিলেন। তিনি ফিরে এসে এক ধর্মান্তরিত মুসলমানের ঘরের চালে আরবদনা' দেখতে পান না। অনুসন্ধানে জানলেন যে লোকটা আবার হিন্দুসমাজের অন্ত্যজ জাতিভুক্ত হয়েছে। ক্রোধান্বিত হয়ে তিনি নবাবের নিকট ফৌজ পাঠাবার আবেদন জানান। নবাব একদল সৈন্য প্রেরণ করেন। ওই সৈন্যদলের সাহায্যে মৌলবি সমগ্র গ্রামের লোকদের মুসলমান ধর্মগ্রহণ করতে বাধ্য করেন।

বাঙলার মুসলমানগণ যে আগন্তুক মুসলমান নন, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে, মুসলমান ইতিহাসকারগণ কেউই লিখে যাননি যে, কোন কালে উত্তরভারত থেকে দলবদ্ধভাবে মুসলমানরা এসে বাঙলা দেশে বসতি স্থাপন করেছিল। বরং আমরা জানতে পারি যে, বাঙলা দেশে যেসকল পাঠান আফগান মুসলমান ছিল, তারা সম্রাট আকবর কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে ওড়িশায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। মুঘল যুগেও পূর্ববাঙলাকে অস্বাস্থ্যকর জায়গা বলে মনে করা হত, এবং যেসকল রাজকীয় কর্মচারী এখানে আসতেন, তাঁরা আবার দিল্লী কিংবা আগ্রায় ফিরে যেতেন। একমাত্র যেখানে কিছু সংখ্যক বিদেশী মুসলমান ছিল, সে জায়গাটা হচ্ছে চট্টগ্রাম। বাণিজ্য উপলক্ষে আরবদেশীয় যেসকল মুসলমান বণিক চট্টগ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেছিল, তারা হচ্ছে তাদের বংশধর।

জোরজুলুম করেই যে মুসলমান করা হত, তা নয়। অনেক হিন্দু স্বেচ্ছায়ও মুসলমান হত। এরা অধিকাংশই হিন্দুসমাজের অবহেলিত নিম্নসম্প্রদায়ের লোক। নিষ্ঠাবান হিন্দুসমাজ এদের হেয় চক্ষে দেখতেন। এসকল সম্প্রদায় ইসলামের সাম্যনীতির দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছিল। তারা মুসলমান শাসকগণ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিতখানকাদ্বারাও আকৃষ্ট হত। খানকাগুলিও দরগার সংলগ্ন প্রতিষ্ঠান, যেখানে আশ্রয় খাওয়া-দাওয়া দুইই পাওয়া যেত। তাছাড়া ছিল পদস্খলিতা হিন্দু সধবা বিধবা। হিন্দুসমাজে এদের কোন স্থান ছিল না। যদি হিন্দু রমণী মুসলমানের সহিত ভ্রষ্টা হত, তা হলে সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে, তার মুসলমান উপপতির পরিবারে বিবির স্থান পেত। ছাড়া ছিল দেশে দাসদাসীর ব্যবসা। অসময়ে দুঃস্থ জনসাধারণ তাদের ছেলে-মেয়ে বেচে দিত। যখন মুসলমানরা তাদের কিনত, তখন তারা তাদের ধর্মান্তরিত করত।

উচ্চশ্রেণীর বর্ণহিন্দুরা খুব কমই ধর্মান্তরিত হত। তবে যাদের যখন যবন-দোষ ঘটত [নিষ্ঠাবান সমাজের পাঁতি অনুযায়ী মুসলমানের খাদ্য আঘ্রাণ করলেও যবন-দোষ ঘটত], নিষ্ঠাবান হিন্দুসমাজ তাদের একঘরে করত। তাদের মধ্যে অনেকেই মর্যাদা পাবার জন্য মুসলমান হয়ে যেত। এছাড়া, মুরশিদকুলি খানের আমলে কোন জমিদার বা ভূস্বামী যদি রাজত্ব দিতে অক্ষম হতেন, তা হলে তাঁকে সপরিবারে মুসলমান ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা হত। বাঙলার মুসলমানরা যে হিন্দুসমাজ থেকেই ধর্মান্তরিত, তা তাদের আচার-ব্যবহার থেকে বুঝতে পারা যায়। এ সকল আচার-ব্যবহার বর্তমান শতাব্দীর গোড়া পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। প্রথমত, তারা ধর্মান্তরিত হবার পূর্বে হিন্দুসমাজে যেসকল কৌলিক বৃত্তি বা পেশা অনুসরণ করত, মুসলমান হবার পরেও তাই করত। 

দ্বিতীয়, এদের ভাষা সাহিত্য থেকেও তাই প্রকাশ পায়। 

তৃতীয়, তাদের নামকরণ থেকেও তাই বুঝতে পারা যায়যেমন কালি শেখ, কালাচাঁদ শেখ, ব্ৰজ শেখ, গোপাল মণ্ডল, হারু শেখ, ইত্যাদি।

চতুর্থ, ধর্মান্তরিত হবার পরেও তারা হিন্দুর অনেক সংস্কার লৌকিক পূজাদি অনুসরণ করত। 

যেমন দুর্গা পূজার সময় তারা হিন্দুদের মতো নতুন কাপড়-জামা পরে পূজা-বাড়িতে প্রতিমা দর্শন করতে যেত। ছেলে-মেয়ের বিবাহের সময়ও তারা হিন্দুর বিধি নিষেধ মানত হিন্দুর পঞ্জিকা অনুসরণ করত। মহামারীর সময় শীতলা, রক্ষাকালী প্রভৃতির পূজা করত শিশু ভূমিষ্ঠ হলে ষষ্ঠী পূজা করত এমন কি, অনেক জায়গায় বিবাহের পর মেয়েরা সিঁদুরও পরত। এসকল আচার- ব্যবহার সাম্প্রদায়িক আন্দোলন মোল্লাদের প্ররোচনায় ক্রমশ বর্জিত হয়েছে। মোট কথা, বাঙালী মুসলমান মূলত বাঙলাদেশেরই ভূমিসন্তান। আজ যে স্বাধীনতা লাভের পর পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা নিজেদের বাঙালী বলে পরিচয় দেয়, তার পিছনে যথেষ্ট ঐতিহাসিক সত্য আছে।

নৃতাত্ত্বিক পরিমাপের দিক দিয়েও এই ঐতিহাসিক সত্য প্রমাণিত হয়। রিজলি যে পরিমাপ গ্রহণ করেছিলেন তা থেকে দেখা যায় যে, পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের শিরকার-সূচক- সংখ্যা ঠিক ওই অঞ্চলের নমঃশূদ্রদের শিরকার-সূচক-সংখ্যার সহিত একেবারে অভিন্ন। এইসকল মুসলমানদের নাসিকাকার-সূচক-সংখ্যা নমঃশূদ্রের চেয়ে বেশি, কিন্তু পোদদের চেয়ে বেশি তফাৎ নয়।  বাঙালী মুসলমান বাঙলার অন্যান্য জাতির ন্যায় বিস্তৃত-শিরস্ক জাতি। উত্তর ভারতের দীর্ঘশিরস্ক জাতিসমূহের সহিত তাদের সংমিশ্রণ খুব কমই ঘটেছে। এক কথায় বাঙালী মুসলমান, বাঙলাদেশেরই ভূমিসন্তান, তারা আগন্তুক নয়

পূর্ববঙ্গ ছাড়াও, বাঙলার জন্য অঞ্চল হতে যে পরিমাপ ক্ষিতীশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় মহাশয় গ্রহণ করেছিলেন,

বাঙ্গালী জীবনে মুসলমান-প্রভাব:

 

মানুষ সামাজিক জীব। ভাষা মনুষ্য সমাজের একটী বাঁধন-দড়ি। ধৰ্ম্ম, রাজনীতি প্রভৃতি আরও কতকগুলি বাঁধন-দড়ী আছে। কিন্তু সকলের গোড়ায় সেই ভাষা। ভাষা সমাজ গড়ে, আবার সমাজও ভাষা গড়ে। ভাষা সমাজের মাতা আবার কন্যা। তাই কোন জাতির ভাষা দ্বারা তাহার সভ্যতার পরিচয় পাওয়া যায়। দুইটি জাতি একস্থানে হইলে তাহাদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান আরম্ভ হয়। সাধারণতঃ বিজিত জাতি সভ্যতা বা সংখ্যায় বিশেষ হীন হইলে স্বীয় ভাষা পরিত্যাগ করিয়া বিজয়ী জাতির ভাষা গ্রহণ করে : যেমন আমেরিকার আদিম নিবাসিগণ গলের ফ্রাঙ্কগণ সভ্যতার বিশেষ পার্থক্য না থাকিলে এবং বিজয়ী জাতি সংখ্যায় অল্প হইলে বিজিত জাতির ভাষা গ্রহণ করে, যেমন ইংলণ্ডে ফ্রান্সে জন্মানগণ এবং ভারতবর্ষে পাঠান তুর্কিগণ। এইরূপ দুইটী ভাষার ঠোকাঠুকিতে একটা ভাষা টিকিয়া যায় বটে, তবুও নিমজ্জিত ভাষা বিজয়ী ভাষার উপর দাগ রাখিয়া যায়। সভ্য ভাষা অসভ্য বা অর্দ্ধ সভ্য ভাষার স্থানের নাম, স্বাভাবিক উৎপন্ন দ্রব্য [natural products] এবং সামাজিক আচার ব্যবহারের নাম ধার করিয়া থাকে। বৈদেশিক প্রভাব অধিক হইলে, সৌখীন দ্রব্য, রাজনীতি, শিল্প, বাণিজ্য, বিজ্ঞান এবং ধর্ম্ম সম্বন্ধীয় শব্দও বৈদেশিক ভাষা হইতে সংগৃহীত হয়। বলা যাইতে পারে, এসমস্ত ধার দায়ে পড়িয়া। কিন্তু বৈদেশিক ভাষা সভ্যতার প্রতি যদি কোনও জাতি অত্যধিক অনুরক্ত হয়, প্রয়োজনের অতিরিক্ত শব্দও সভ্যতার পরিচায়করূপে নিজে ব্যবহার করিয়া থাকে। এইরূপে অনেক বৈদেশিক গালাগালিও ভাষায় প্রবেশ লাভ করে। দুইটী জাতির পরস্পর মেশামেশি না থাকিলেও, বিজাতীয় ভাষার আলোচনার দ্বারা সেই ভাষার প্রভাব অন্যতরে সংক্রামিত হইতে পারে : যেমন ইংরাজি সাহিত্যে লাটিনের প্রভাব। এক্ষণে দেখা যাউক, ধার করা শব্দগুলির সাহায্যে আমরা বাঙ্গালী জীবনে মুসলমান-প্রভাব কতদূর ঠিক করিতে পারি।

ইংলণ্ডে নরমানদিগের গলে ফ্রাঙ্কগণের যে অবস্থা হইয়াছিল, বাঙ্গালায়ও বিদেশাগত মুসলমানদিগের সেই অবস্থা হইয়াছে। তাঁহারা জাতীয় ভাষা পরিত্যাগ করিয়া এখন বাঙ্গালী সাজিয়াছেন, কিন্তু বাঙ্গালী জীবনের সুখ স্বচ্ছন্দতার অনেক জিনিষ তাঁহাদেরই মেহেরবানীতে। মুসলমানের সর্ব্বাপেক্ষা মহৎ দান 'হিন্দু' এই নাম। অ ব্রাহ্মণ চণ্ডাল আৰ্য্য অনাৰ্য্য ব্রাহ্মণ ধর্ম্মাশ্রিত সকলেরহিন্দু' এই আখ্যা প্রদান করিয়া মুসলমান হিন্দুর জাতীয়তা গঠনে সাহায্য করিয়াছেন। বাঙ্গালীর ঘরের আসবাব' গুলির কথা এখন ধরা যাউক। মুসলমানদিগের আসিবার পূর্ব্বে বাঙ্গালীর ঘরের সাজসজ্জা খুব কম ছিল। এখনও দূরবর্তী পল্লীতে কৃষকের প্রায় তাহাই আছে। বাঙ্গালী তখন শুইতেন খাটে কিংবা পালঙ্কে। বিছানার মধ্যে চেটাই, তাহার উপর হয়ত একখানি কাঁথা। মাথা রাখিবার জন্য শিয়রে একটু জায়গা বিচালী ইত্যাদি দিয়া উঁচু করিয়া রাখিতেন। মুসলমানদের নিকট বাঙ্গালী তপ্তপোষ’“তোষকতাকিয়া’ ‘বালিশএবংগালিচারব্যবহার শিখিলেন। সাবেক পিঁড়া চৌকির উপরমেজ দুই একটী ঘরে দেখা যাইতে লাগিল। বেতের বাঁশের পেটরার সঙ্গে কাষ্ঠের সিন্দুক' গৃহ-শোভা বর্দ্ধন করিতে লাগিল। আরসির ব্যবহার পূর্ব্ব হইতে ছিল কিন্তু অল্প। এখন ঘরে ঘরেআয়নার ব্যবহার আরম্ভ হইল। বাঙ্গালী বড় মানুষের বাড়ীতে প্রদীপ ঝাড়ের সহিত শামাদান' ‘দেয়ালগীর’ ‘ফানুসএবংমশাল’‘রোশনাইকরিতে লাগিল। বড়লোকের বাড়ীতে মুসলমানের দেখাদেখিপরদাঝুলিতে আরম্ভ করিল। মেটে হাঁড়িকুড়ি, কলসী পাথর এবং পিতলের ঘড়া, থালা, ঘটী, বাটী প্রভৃতি তখনও বাঙ্গালীর ঘরে ব্যবহৃত হইত, এখনও হয়। কিন্তুদেচী’‘রেকাবী’, ‘তরী’ ‘সুরাইএবং 'কুজা' ব্যবহার বাঙ্গালী মুসলমানের নিকট শিখিয়াছেন।

বাঙ্গালীর পোষাকেরও প্রায় পনের আনা মুসলমানের প্রদত্ত। অন্তত এজন্য বাঙ্গালী মুসলমানের নিকট কৃতজ্ঞ থাকিবেন। মুসলমান আসিবার পূর্ব্বে পুরুষদিগের ধুতি উড়ানি জুতা এবং স্ত্রীলোকদিগের শাড়ী ব্যতীত আর কোন কাপড় ছিল না। দরজী' ব্যবসায় কেহ জানিত না এবং বাঙ্গালীর তাহাতে কোন প্রয়োজনও ছিল না। এখনও পূজাপার্ব্বণে বাঙ্গালী -সেলাই বস্ত্র পবিত্র মনে করিয়া ব্যবহার করিয়া থাকেন। মুসলমানের নিকট বাঙ্গালীজামা’ ‘মোজা’, ‘কামিজ’, ‘পিরান' এবং রুমালের ব্যবহার শিখিয়াছেন। পূর্ব্বে চেলীর শাড়ী ধুতি বাঙ্গালীর গৌরবের জিনিস ছিল। মুসলমানের আমলেকিংখাব, ‘বনাত’, ‘মখমল’, ‘শাল’, ‘তঞ্জাব', ‘পশমীকাপড় এবংআলোয়ানের' বহুল প্রচলন আরম্ভ হইয়াছে।

মুসলমান এদেশে দরজী আনিয়াছেন। সে দিন পৰ্য্যন্ত মুসলমানেরাই দরজীর ব্যবসায় করিতেন। দরজীর সহিতকাচী' এবং 'চাকু' এদেশে আসিয়াছে।ওরেব’, ‘বখেয়া’, ‘সঞ্জাব’, ‘রিফু’, ‘জেব' এবংআস্তিন' মুসলমান দরজীরই ভাষা। মুসলমান ধৰ্ম্ম যেমন বিলাসিতা ঘৃণা করে, মুসলমান বড়লোক তেমনই বিলাসী। বাদশাহ, নওয়াব, এবং আমীর ওমরাহদিগকে দেখাদেখি বাঙ্গালী মহাশয়ও বেশসৌখীনবাবু হইয়া উঠিয়াছিলেন। আতুব' গোলাব জল, 'সাবান' এবং 'চশমার' ব্যবহার মুসলমানেরই অনুকরণে।ঢোল' [দহল] ‘সেতার' ‘তবল’ ‘রবাব' মুসলমানরাই এদেশে আনিয়াছেন। মুসলমানের কাছে বাঙ্গালীপোলাও’, ‘কোম্মা’, ‘কোফতা’, ‘কালিয়া’, ‘কাবাব’, ‘সিরকা’, বাঙ্গালী হিন্দু, এখনওকানুনগো’, ‘মীরবহর’, ‘সরখেল’, ‘মহলানবিশ’, ‘খাশনবিশ’, ‘মল্লিক’, ‘রায়’, ‘সরকার’, ‘খাঁ’, ‘মজুমদার’, ‘মুস্তফী, ‘মুনশীপ্রভৃতি মুসলমান বাদশাহ নবাবদিগের প্রদত্ত উপাধিগুলি সাদরে বহন করিতেছেন। সত্যপীরকে সত্যনারায়ণ আখ্যা প্রদান করিয়া এবং ফকিরদাস ইত্যাদি নাম দ্বারা মুসলমান পীর ফকিরের প্রতি বাঙ্গালী হিন্দু এখনও আপনাদের ভক্তি দেখাইতেছেন।

 

বাঙ্গালা ভাষার ব্যাকরণেও মুসলমান প্রভাব লক্ষিত হয় :

খোর’[গাঁজাখোর ইত্যাদি শব্দে], ‘দার' [ঠিকাদার ইত্যাদি শব্দে], 'দান' [পিকদান ইত্যাদি শব্দে], এবংগিরি’ [গুরুগিরি ইত্যাদি শব্দে] তদ্ধিত প্রত্যয়ের কার্য্য করিতেছে। নর মাদী শব্দ প্রয়োগ দ্বারা ইতর জন্তুর লিঙ্গভেদ পারসী ব্যাকরণের অনুরূপযেমন, নরপায়রা, মাদী ঘোড়া ইত্যাদি।জমান’, ‘কমান’, ‘বানানএই ক্রিয়াপদগুলিও আরবী পারসী হইতে গৃহীত। ধন-‘দৌলত’, ‘গরীব’- ‘কাঙ্গাল’, হাট-‘বাজার’, ‘জিনিস’-পত্র, লজ্জা-‘সরম’, ‘চালাক’-চতুর, কাণ্ড-‘কারখানা’‘লোক- ‘লস্কর’, খানা-‘খাদক’, শাক-‘সবজী’, ঝড়-‘তুফান’, মুটে-‘মজুর’, হাসি-‘খুশী' প্রভৃতি শব্দযুগ্মে সংস্কৃত আরবী-পারসীজাত শব্দগুলি যেমন গলাগলি করিয়া রহিয়াছে, বাঙ্গালী হিন্দু-মুসলমান কি এইরূপ গলাগলি করিয়া থাকিবে না? ১৩১৮ বঙ্গাব্দেকোহিনূর' পত্রিকায় প্রকাশিত। -বিষয়ে বর্তমানে বিতর্ক উঠেছে। [দ্রষ্টব্য : ‘লোকসংস্কৃতি গবেষণা বিশেষ সংখ্যাপঞ্জিকা সংস্কৃতি' : ১৪০৫]

বাঙ্গালী মুসলমানের মাতৃভাষা :

 

কলিকাতা শহর এখন বাঙ্গালা দেশের রাজধানী। সুতরাং বাঙ্গালা দেশেরবাঙ্গালী মুসলমানের মাতৃভাষা সম্বন্ধে আলোচনা করিতে হইলে, প্রথমে কলিকাতার মুসলমান সমাজ, এবং তাহাদের মাতৃভাষা সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া আবশ্যক।

সাধারণতঃ কলিকাতা সহরে এখন পাঁচ শ্রেণীর মুসলমান দেখিতে পাওয়া যায়, যথা

 

. যাঁহারা ভারতবর্ষের বাহিরের লোক, কর্ম্মোপলক্ষে কলিকাতায় বাস করিতেছেন, এবং কর্ম্ম শেষ হইলে আপনার মাতৃভূমির ক্রোড়ে ফিরিয়া যাইবেন। ইঁহারা নিজেকে কলিকাতার লোক বলিয়া জনসমাজে পরিচিত করিতে লজ্জা ঘৃণা বোধ করিয়া থাকেন। ইঁহাদের মাতৃভাষা আরবী পার্শী।

 

. যাঁহারা কলিকাতার, এবং বাঙ্গালা দেশের অধিবাসী নহেন, কর্ম্মের জন্য ভারতের অপরাপর প্রদেশ হইতে এখানে আসিয়া অস্থায়িভাবে বাস করিতেছেন, এবং কর্ম্ম শেষ হইলে, স্ব স্ব প্রদেশে ফিরিয়া যাইবেন, অথবা কলিকাতাতেই আজীবন অবস্থান করিবেন। ইঁহারা নিজেকে বাঙ্গালী বলিয়া স্বীকার করেন না, এবং স্বীকার করিতে প্রস্তুত নহেন। ইঁহাদের মাতৃভাষা ঊর্দু, হিন্দী, গুজরাথী, তেলেগু, তামীল, উড়িয়া প্রভৃতি। ইঁহাদের মধ্যে হিন্দী-ভাষা-ভাষীর সংখ্যাই অধিক।

 

. যাঁহারা বাঙ্গালা দেশের বিভিন্ন স্থানের বাসিন্দা, কৰ্ম্মোপলক্ষে কলিকাতায় আসিয়া বাস করিতেছেন, এবং কর্ম্মের শেষে স্ব স্ব জন্মস্থানে ফিরিয়া হইবেন, এবং নিজেকে খাঁটী বাঙ্গালী বলিয়া জন-সমাজে পরিচিত করিতে সৰ্ব্বদাই ইচ্ছুক। এমন কি, নিজেকে বাঙ্গালী বলিয়া পরিচিত করিতে পারিলে, শ্লাঘা বোধ করিয়া থাকেন। ইঁহাদের মাতৃভাষা বাঙ্গালা

 

. কলিকাতা-শহর-পত্তনের পূর্ব্বে, সহর পত্তনের সময়, এবং তাহার কিঞ্চিৎ পরেও যাঁহারা বর্ত্তমান কলিকাতা পঞ্চান্ন গ্রামের মধ্যস্থিত শিবাদহ বা শিব্দহ, আঞ্জির বাগান, গফুর সাহেব [১৮৭৫-১৯৬১] খাসপুর২৪ পরগণার অধিবাসী ছিলেন। পুঁথি সাহিত্য এবং পুরাতত্ত্ব বিষয়ক প্রবন্ধাবলী বাঙলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য। 'তিতুমীর' তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। প্রবন্ধটি সাহিত্য পত্রিকার ২৭ বর্ষ সংখ্যাআষাঢ় এবং আশ্বিন ১৩২৪ থেকে গৃহীত সুঁড়া, হাতীবাগান, লিচুবাগান, কোমেদান বাগান, মেহদিবাগ, তালতলা, সুতানুটী, গোবিন্দপুর, ধাপধাড়া, মলঙ্গা, ফার্সিবাগান, বালিগঞ্জ, কেসিয়াবাগান, গোবরা, শরিফপুর, পেয়ারাবাগান, লডিকপুর, চাপাতলা, শানকিভাঙ্গা, মূর্ত্তিবাগান, হরিণবাড়ী প্রভৃতি স্থানে বাস করিতেন ; এবং বাঙ্গালা ভাষাকে স্বীয় মাতৃভাষা বলিয়া স্বীকার করিতে কুণ্ঠিত হইতেন না, বরং শ্লাঘা বোধ করিতেন, এবং বর্ত্তমান সময় সেই সকল মুসলমানদিগের যে সকল বংশধরেরা কলিকাতায় বাস করিতেছেন, এবং বাঙ্গালা ভাষাকে স্বীয় মাতৃভাষা বলিয়া স্বীকার করিয়া থাকেন।

 

. কলিকাতার আদিম বাঙ্গালী মুসলমান অধিবাসীদিগের যে সকল বংশধরেরা আজিও কলিকাতায় বাস করিতেছেন, এবং বাঙ্গালা দেশের বিভিন্ন স্থান হইতে যে সকল বাঙ্গ ালী মুসলমান কৰ্ম্মোপলক্ষে কলিকাতায় আসিয়াছিলেন, এবং আজীবন কলিকাতাতেই বাস করিয়াছিলেন, আর তাঁহাদের যে সকল বংশধর আজিও কলিকাতায় বাস করিতেছেন। বাঙ্গালা দেশ ব্যতীত ভারতের অপরাপর প্রদেশ হইতে যে সকল মুসলমান কৰ্ম্মোপলক্ষে কলিকাতায় আসিয়াছিলেন, কলিকাতাতেই বাস করিয়াছিলেন, এবং তাঁহাদের যে সকল বংশধরেরা কলিকাতাতেই বাস করিতেছেন। ভারতবর্ষের বাহিরের যে সকল মুসলমান কৰ্ম্মোপলক্ষে কলিকাতায় আসিয়া স্থায়িভাবে কলিকাতার অধিবাসী হইয়াছিলেন, এবং তাঁহাদের যে সকল বংশধর আজিও কলিকাতায় বাস করিতেছেন।

 

বর্তমান সময় কলিকাতার মোট অধিবাসীর সংখ্যা প্রায় এগার লক্ষ, তন্মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা প্রায় চারি লক্ষ। এই চারি লক্ষ মুসলমানের মধ্যে উক্ত প্রথম শ্রেণীর মুসলমানের সংখ্যা প্রায় শতকরা এক জন। দ্বিতীয় শ্রেণীর মুসলমানের সংখ্যা প্রায় শতকরা দশ জন। তৃতীয় শ্রেণীর মুসলমানের সংখ্যা প্রায় শতকরা ২৫ জন। চতুর্থ শ্রেণীর মুসলমানের সংখ্যা প্রায় শতকরা জন ;এবং শেষোক্ত পঞ্চম শ্রেণীর মুসলমানের সংখ্যা প্রায় শতকরা ৫৯ জন। এই শেষোক্ত পঞ্চম শ্রেণীর মুসলমানেরা আপনাদিগকেক্যালকেশিয়ান' মুসলমান বলিয়া বাক্য ব্যবহারের দ্বারা পরিচিত করিয়া থাকেন। কিন্তু শেষোক্ত পঞ্চম শ্রেণীরক্যালকেশিয়ান' মুসলমানদিগের সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করিতে হইলে, উহাদিগকে পুনরায় দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা আবশ্যক হইয়া পড়ে। সুতরাং আলোচনার সুবিধার জন্য, আমি প্রথমে উহাদিগকে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়া, আলোচনায় প্রবৃত্ত হইতেছি।

এই দুই শাখা-শ্রেণীর মধ্যে যাঁহারা প্রথম শাখা-শ্রেণীর অন্তর্গত, তাঁহারা তাঁহাদের পূৰ্ব্ব মাতৃভাষা ভুলিয়া একপ্রকার ভাঙ্গা উর্দুকে আপনাদের মাতৃভাষা রূপে গড়িয়া লইয়াছেন আর যাঁহারা দ্বিতীয় শাখা-শ্রেণীর অন্তর্গত, তাঁহারা তাঁহাদের পূর্ব্ব মাতৃভাষাকে, সম্পূর্ণরূপে বর্জ্জন করিয়া, অর্থহীন একপ্রকার নূতন ভাষার সৃষ্টি করিয়াছেন ; এবং সেই ভাষাকে তাঁহারা তাঁহাদের মাতৃভাষা বলিয়া স্বীকার করিয়া লইয়াছেন।

দিল্লী এবং লক্ষ্ণৌ, এই উভয় স্থানের উর্দু ভাষাই এখন উর্দু-ভাষা-ভাষীদিগের আদর্শ এক দল দিল্লীর উর্দুকে বিশুদ্ধ উর্দূ বলিয়া গর্ব্ব করিয়া থাকেন ; আর এক দল তাহার তীব্র প্রতিবাদ করিয়া বলিয়া থাকেন যে, “দিল্লীর উর্দূ অতি জঘন্যলক্ষ্ণৌএর উর্দূ খাঁটী বিশুদ্ধ।কিন্তু এতদুভয় দলের কোনও দলই পূর্ব্বোক্ত পঞ্চম শ্রেণীর প্রথম শাখা-শ্রেণীস্থক্যালকেশিয়ান মুসলমানদিগের ভাঙ্গা ঊর্দুকে পছন্দ করেন না। পরন্তু ইঁহারাও এখন ইংরাজী স্বরচিত ভাঙ্গা ঊর্দ্ধ ব্যতীত অপর কোনও ভাষা জানেন না  ‘প্রায় শতকরা ৫৯ জনক্যালকেশিয়ান' মুসলমান, পঞ্চম শ্রেণীর অন্তর্গত।' এই ৫৯ জনের মধ্যে, উল্লিখিত প্রথম শাখা-শ্রেণীস্থ মুসলমানের সংখ্যা প্রায় ১০ জন, এবং অবশিষ্ট ৪৯ জন মুসলমান, পঞ্চম শ্রেণীস্থ দ্বিতীয় শাখা-শ্রেণীর অন্তর্গত। এই দ্বিতীয় শাখা-শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ৪৯ জন মুসলমানই যে আপনাদের পূর্ব্ব মাতৃভাষা ত্যাগ করিয়া, এক অর্থহীন অভিনব ভাষার সৃষ্টি করিয়াছেন, তাহা আমি পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি। এক্ষণে আপনাদের অবগতির নিমিত্ত নিম্নে তাঁহাদের সেই অভিনব ভাষার দুই চারিটী শব্দ প্রমাণ স্বরূপ উপস্থিত করিতেছি। যথা—“আইস্থা”,“গেইস্থা”, “খাইস্থা”,“বোলেহে”, “খেলেহে”, “জাহে”, “কা”, “কাহে”, “কা-বে”, “হাঁফ্”, “হাঁজী”, “হামার”, “পিইস্-হ্যায়”, “সুইস্- হ্যায়”, “সেইস্-হ্যায়”, “গ্যায়োতানি”, “খায়ো-সনি”, “বোলো-সনি”, “তানিসা”, “এনে আও”, “এনে-জীপ্রভৃতি।

দুঃখের বিষয়, এই শ্রেণীর মুসলমানদিগকে, উর্দু অথবা বাঙ্গালা ভাষা শিক্ষা দিবার কোনও চেষ্টাই কেহ করেন না। বরং এই দুৰ্ব্বোধ্য ভাষাকেও এখন স্বার্থের খাতিরে উর্দু ভাষা বলিয়া স্বীকার করা হইতেছে। তবে সুখের বিষয় এই যে, ইঁহারা আপনাদের আনন্দে আপনারাই মগ্ন রহিয়াছেন। কাহারও কোনও আচার ব্যবহার কার্য্যের উপর হস্তক্ষেপ করিবার কোনও চেষ্টাই ইঁহারা করেন না। কাহারও উপর স্বীয় আধিপত্য বিস্তার করিবার আগ্রহ আকাঙ্ক্ষা ইঁহাদের নাই। কিন্তু ইঁহাদের উপরের স্তরে যাঁহারা, সেই প্রথম শাখা-শ্রেণীর মুষ্টিমেয় মুসলমানগণ, আপনাদিগকে বাঙ্গালী বলিয়া স্বীকার করেনই না, অধিকন্তু বাঙ্গালী মুসলমানদিগকে দলে টানিয়া লইয়া, তাঁহাদের উপর স্বীয় আধিপত্য বিস্তার করিবার জন্য সৰ্ব্বদাই ব্যস্ত

উক্ত শতকরা ৪৯ জনকে বাদ দিলে, কলিকাতার মুসলমানদিগের মধ্যে খাঁটী ঊর্দ্ধ- ভাষা-ভাষীর সংখ্যা শতকরা ২০ জনের অধিক নহে। এই ২০ জনের মধ্যে দশ জনের ভাষা ভাঙ্গা-ঊর্দু, এবং ১০ জনের ভাষা খাঁটী উর্দু। পরন্তু কলিকাতায় খাঁটী বাঙ্গালা-ভাষা-ভাষীর সংখ্যা শতকরা প্রায় ২৫ জন। সুতরাং কথা নিঃসঙ্কোচে বলা যাইতে পারে যে, বাঙ্গালী মুসলমানেরা বাঙ্গালার রাজধানী কলিকাতার উপর স্বীয় অধিকার হারান নাই। কলিকাতার মুসলমানদিগের মধ্যে, আমি যে পরিমাণ বাঙ্গালী মুসলমানদিগের কথা উপরে উল্লেখ করিয়াছি, ৩০। ৩৫ বৎসর পূর্ব্বে কলিকাতায় খাঁটী বাঙ্গালী মুসলমানের সংখ্যা তাহা অপেক্ষা আরও অধিক ছিল। দুঃখের বিষয়, সে সময়ের কলিকাতার বাঙ্গালী মুসলমানদিগের অনেকের বংশ এখন লোপ পাইয়াছে, এবং অনেকের বংশধরেরা এখন মূর্খতা প্রযুক্ত আপনাদের বাঙ্গালীত্ব হারাইয়া ফেলিয়াছেন।

অধিকদিনের কথা বলিব না। ৩০। ৩৫ বৎসর পূর্ব্বে, খাস কলিকাতার মুসলমানদিগের কি ভাষা ছিল, আমি নিম্নে তাহার দুই একটী দৃষ্টান্ত দিতেছি। তখন আমাদের বাসা শিয়ালদহ হাজীপাড়ায় ছিল। আমার পূজনীয় পিতৃদেব ৬০। ৬৫ বৎসর স্থানে বাস করিতেছেন। প্রত্যহ প্রাতে আমাদের বাসায় একটি ছোট রকমের মজলিস্ বসিত, এবং বেলা প্রায় ৯।১০ টার সময় মজলিস ভাঙ্গিত। পাড়ার যে সকল লোক সেই মজলিসে সমবেত হইতেন, তাঁহাদের কাহারও বয়স ৬০ বৎসরের কম ছিল না। সমবেত মহাত্মাদিগের মধ্যে মওলানা আব্দল খালেক মরহুম’, হাজী আব্দল রাজ্জাক মরহুম, বাবু গিরীশচন্দ্র কর, বাবু হরিদাস দত্ত, মুনশী বেলায়েৎ হোসেন ওরফে কালীদাস, মুনশী মতিয়ার রহমান মরহুম ওরফে শ্যাম বাবু, মুনশী শরাফৎ হোসেন মরহুম ওরফে শরীফ বাবু', মুনশী গোলাম রহমান মরহুম", মুনশী মিনহাজদ্দিন মরহুম৬, মুনশী ইতিরাজ আলী মরহুম', শেখ আহমদ্ ওরফে আমু ওস্তাগার মরহুম মুনশী মণিরউদ্দিন আহমদ মরহুম` প্রভৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

মজলিসে গল্প-গুজব কথাবার্তা বাঙ্গালা ভাষাতেই হইত। দেশের, দশের সমাজের কথা হইত। সমাজ-শাসনের পরামর্শ চলিত। কদাচারী পাপকার্য্যে রত ব্যক্তিদিগকে [হিন্দু- মুসলমান-নির্ব্বিশেষে] শাসন করিবার ব্যবস্থা হইত। পাড়া প্রতিবেশীদিগের অভাব অভিযোগ শ্রবণ করিয়া, তৎপ্রতীকারের জন্য সু-পথ অবলম্বন করা হইত পাড়ার মামলা-মোকদ্দমা বড় একটা আদালতে যাইতে পারিত না ইহা ব্যতীত দুধ, ঘি, মাছ, মাংস, তরি-তরকারী, পোলাও- কোম্মা প্রভৃতি খাদ্যাখাদ্যের কথাও হইত। এক রবিবারে বড় বড় মৎস্যের গল্প, পোলাও- কোর্ম্মার কথা হইতেছিল। হরিবাবু বলিয়াছিলেন, “আমাদের বাঙ্গালীরা আপনাদের ন্যায়, উত্তম খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুত করিতে জানেন না। সুখাদ্য মুখরোচক খাদ্য আপনাদের বাড়ীতেই প্রস্তুত হয়, এবং আপনাদের মুসলমানেরাই কার্য্যে বিশেষ পারদর্শী।

আমার বেশ মনে আছে, হরিবাবুর এই কথা শুনিয়া, মুনশী মণিরদ্দিন আমু ওস্তাগার বিশেষ অসন্তোষের ভাব প্রকাশ করিয়া বলিয়াছিলেন, “হরিবাবু। আপনার দেখিতেছি বুদ্ধিলোপ পাইয়াছেমতিভ্রম হইয়াছে!” হরিবাবু তাঁহাদের ভাব-ভঙ্গী দেখিয়া তজ্জন-গৰ্জ্জন শুনিয়া অবাকহতবুদ্ধি হইয়া গেলেন, এবং কয়েক মুহূর্ত্ত নিস্তব্ধভাবে থাকিয়া, মৃদুস্বরে বলিলেন, “মহাশয় ! আমি কি অপরাধ করিলাম? আমি কোনও অন্যায় কথা আপনাদিগকে বলি নাই ?”

তখন ওস্তাগার সাহেব বলিলেন, “ইহা অপেক্ষা যদি আরও কিছু অন্যায় বলিবার ইচ্ছা থাকে, বলুন। আপনি বাকীই বা রাখিয়াছেন কি? আপনি যদি আমার গণ্ডদেশে দুইটী চপেটাঘাত করিতেন, আমি বিনা বাক্যব্যয়ে তাহা সহ্য করিতাম ; কিন্তু ইহা অসহ্য। তখন দত্তমহাশয় অতি সঙ্কুচিতভাবে বলিলেন, “যদি অপরাধ হইয়া থাকে, তাহা আমার জ্ঞানকৃত নহে। আপনারা অনুগ্রহপূর্বক বলিয়া দিন, আমার অপরাধ কি?”

ইহা শুনিয়া মওলানা আব্দল খালেক সাহেব বলিয়াছিলেন, “হরিবাবু ! আপনি বুঝিতে পারিতেছেন না, হিন্দু মুসলমানকে যে আপনি পৃথক করিয়া ফেলিতেছেন। বাঙ্গালা দেশের প্রত্যেক অধিবাসীসে হিন্দু হউক, মুসলমান হউক, অথবা খৃষ্টান, বৌদ্ধ, ব্রাহ্ম হউকসে বাঙ্গালী। বর্তমান সময়ে বাঙ্গালা দেশে পাঁচটী ধৰ্ম্মসম্প্রদায় বাস করিতেছেন, হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্টান, বৌদ্ধ ব্রাহ্মা। দেশের মঙ্গলামঙ্গল এই পাঁচটী ধর্ম্ম-সম্প্রদায়ের মঙ্গলামঙ্গলের উপর নির্ভর করিতেছে। কিন্তু পাঁচটী ধৰ্ম্ম-সম্প্রদায় যতদিন কলহ বিরোধ ত্যাগ না করিবে, যতদিন পরস্পর একতাসূত্রে আবদ্ধ না হইবে, ততদিন কাহারও মঙ্গল হইবে না। কারণ, একের ধর্ম্মবিশ্বাস অপরের ধর্ম্মবিশ্বাসের সম্পূর্ণ বিপরীত।

 “তবে একতার এক উপায় আছে। সে উপায় এই যে, হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্টান, বৌদ্ধ ব্রাহ্ম, এই পাঁচটী ধৰ্ম্ম-সম্প্রদায়কে বুঝাইয়া বিশ্বাস করাইয়া দিতে হইবে যে, তাহারা যে যে ধৰ্ম্মাবলম্বীই হউক না কেন, তাহারা সকলেই বাঙ্গালী। ধর্ম্মের হিসাবে তাহারা হিন্দু, মুসলমান, কিংবা অপর কোনও ধর্ম্মাবলম্বী নামে অভিহিত হউক না কেন, কিন্তু দেশ হিসাবে তাহারা সকলেই বাঙ্গালী। এখন হিন্দু-মুসলমান প্রভৃতির মধ্যে এই বিশ্বাস ক্রমশঃ দৃঢ়তর হইতেছে। কিন্তু এই সময় যদি হিন্দুকে বাঙ্গালী বলিয়া মুসলমান হইতে পৃথক করিয়া লওয়া হয়, তাহা হইলে ভবিষ্যৎফল বড়ই বিষময় হইবে।

বাঙ্গালী বলিয়া কোনও ধৰ্ম্ম নাই। আমি ইসলামপন্থী, আমিও যেমন বাঙ্গালী, আপনি হিন্দুপন্থী, আপনিও সেই প্রকার বাঙ্গালী। বাঙ্গালা দেশে জন্মিয়াছি, বাঙ্গালা দেশে বাস করিতেছি, বাঙ্গালা ভাষায় মনের ভাব ব্যক্ত করিয়া থাকি, এবং বাঙ্গালার জল, বায়ু স্বভাব আমাদের জীবনধারণের প্রধান অবলম্বন ; সুতরাং আমরা বাঙ্গালী। আমাদের বাঙ্গালী নাম গৌরব সুখের বিষয়। ওস্তাগর সাহেবের অসন্তোষের কারণ এই যে, অদ্য আপনি একা এই যে বাঙ্গালী নামটা কেবল হিন্দুর অধিকারে আনিতেছেন, কল্য আপনার অনুকরণে আর দশ জন ঐরূপ চেষ্টা করিবে। তাহা হইলে বিশ বৎসরের পর দেখিবেন, হিন্দু-মুসলমানের একতা ভাঙ্গিয়া চূর্ণ বিচূর্ণ হইয়া গিয়াছে।

হিন্দু মুসলমানকে ছাড়িয়া, এবং মুসলমান হিন্দুকে ছাড়িয়া কি এক মুহূর্ত্তও দেশে বাস করিতে পারিবে? দেশের হিন্দুরাই যদি বাঙ্গালী হইবার চেষ্টা করে, এবং মুসলমানদিগকে উপেক্ষা করে, তাহা হইলে উপেক্ষিত মুসলমান হয় বাঙ্গালীত্ব অস্বীকার করিয়া বসিবে। বাঙ্গালা দেশের বাঙ্গালীর দুর্ভাগ্যবশতঃ যদি কখনও এরূপ দুঃসময় উপস্থিত হয়, তাহা হইলে জানিবেন, বাঙ্গালাদেশ ছারেখারে যাইবে। ওস্তাগর সাহেব বড়ই দূরদর্শী, তাই ভবিষ্যৎ চিন্তা করিয়া, অঙ্কুরেই ইহার মূলোচ্ছেদে যত্নবান হইয়াছেন।”* মওলানা সাহেবের এই প্রকার উপদেশপূর্ণ বাক্য শ্রবণ করিয়া দত্তমহাশয় নিজের ত্রুটী বুঝিতে পারিয়া, আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করিয়াছিলেন।

                                                 কলিকাতায় মাপাড়া মহাল্লার অধিবাসী মৌলবী ইম্তিয়াজ আলী মরহুমের মুখে শুনিয়াছিলাম, তাঁহারা কলিকাতা সহর পত্তনের পূর্ব্ব হইতে বংশপরম্পরায় মহাল্লায় বাস করিয়া আসিতেছিলেন।মৌলবী সাহেব মরহুমের কনিষ্ঠ ভ্রাতা-মুশী আহসান আলী সাহেবের মুখে শুনিয়াছি, আজমগড় জেলার মাদারবক্শ নামক এক ব্যক্তি মহাল্লায়, তাঁহাদের বাড়ীর পার্শ্বে বাস করিত। এক দিন কোনও কারণবশতঃ মাদারবক্শের সহিত মৌলবী সাহেব মরহুমের ঝগড়া হয়। মাদারবক্শ হিন্দী বা ঊর্দু ভাষায় কথা বলিতেছিল, এবং মৌলবী সাহেব বঙ্গ ভাষায় তাহার উত্তর দিতেছিলেন। এই জন্য মাদারবক্শ্ বলিয়াছিল, “আপকো খেয়াল রাখা * প্রবন্ধটি আজ থেকে ৮৬ বছর আগে লেখা। চাহিয়ে কে ম্যায় বাংলা জবান মোত্লাকান্ নেহি সমঝতাহুঁ। আওর আপকো এই ভি খেয়াল রাখা চাহিয়ে কে আপ্ আলেম্ হ্যাঁয়। ইস্তারাইসে বাংলা জবান্ ইস্তেয়ামাল্ কর্ণেসে আলেমোঁকি ইজ্জাত মে ধাক্কা লাগ্জাতা হ্যায়। অর্থাৎআপনার মনে রাখা উচিত যে, আমি আদৌ বাঙ্গালা ভাষা বুঝি না ; আর ইহাও আপনার স্মরণ রাখা উচিত যে, আপনি [আরবী ফার্সী ভাষায় পণ্ডিত] আলেম। আপনি যদি এই প্রকারে বাঙ্গালা ভাষা ব্যবহার করেন, তাহা হইলে আলেমদিগের সম্মানের লাঘব হইবে। মৌলবী সাহেব মরহুম ঊর্দু ভাষায় মাদারবশের এই কথার যে উত্তর দিয়াছিলেন, আমরা নিম্নে তাহার বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করিতেছি।

মৌলবী সাহেব মরহুম বলিয়াছিলেন, “তোমারও মনে রাখা উচিত যে, এই কলিকাতা সহরটাও বাঙ্গালা দেশের একাঙ্গ। এখানকার ভাষা বাঙ্গালা। আমি যখন তোমার দেশে যাইব, তখন ঊর্দু অথবা হিন্দী ভাষায় কথা কহিব। এখন তুমি আমাদের দেশে আসিয়াছ, তোমাকে এই দেশের ভাষায় কথা কহিতে হইবে। তুমি যেমন ঊর্দু বা হিন্দীকে তোমার মাতৃভাষা মনে কর, আমিও তেমনই বাঙ্গালা ভাষাকে আমার মাতৃভাষা বলিয়া স্বীকার করি প্রয়োজন তোমার, আমার নহে। তোমাকেই আমাদের ভাষায়, তোমার মনের ভাব ব্যক্ত করিয়া আমাদিগকে বুঝাইতে হইবে। নিজের বাড়ীতে বসিয়া কেন আমি আমার মাতৃভাষাকে ত্যাগ করিব? মৌলবী মওলানা হইলেই যে ঊর্দূ ভাষায় কথা কহিতে হইবে, কথা তোমাকে কে বলিল? উর্দুভাষাও ঐস্লামিক ভাষা নহে? মুসলমান রাজত্বের সময়, সৈন্যদিগের মধ্যে ভাবের বিনিময় করিবার জন্য, উর্দু ভাষার সৃষ্টি হইয়াছিল।  যে সকল ইংরাজ শাসনকর্তা দেশ শাসন করিতেছেন, তাঁহারা যেমন প্রজার মনের ভাব বুঝিবার জন্য, প্রজার সহিত ভাবের বিনিময় করিবার জন্য বাঙ্গালা ভাষা শিক্ষা করিয়া থাকেন, তোমরাও সেই প্রকার নিজের মনের ভাব আমাদিগকে বুঝাইবার জন্য, এবং আমাদের সহিত মিলিয়া মিশিয়া কৰ্ম্ম করিবার জন্য, বাঙ্গালা ভাষা শিক্ষা কর না কেন? বাঙ্গালা দেশে বাস করিবে, বাঙ্গালীর সহিত সম্বন্ধ রাখিয়া চলিবে, এবং নিজের দেশের ভাষায় বাঙ্গালীর সহিত বাক্যালাপ করিবে, ইহা কখনও হইতে পারে না। হয় তোমাদিগকে বাঙ্গালা দেশ ছাড়িতে হইবে, নতুবা বাঙ্গালা ভাষা শিক্ষা করিতে হইবে।

মওলানা আব্দল খালেফ্ মরহুম মৌলবী ইমতিয়াজ আলী মরহুমের উক্তির সারমর্ম্ম উপরে লিপিবদ্ধ করিয়াছি। উহা হইতে বেশ বুঝা যাইতেছে যে, ৩০। ৩৫ বৎসর পূর্ব্বে খাঁটী বাঙ্গালা ভাষাই কলিকাতার মুসলমানদিগের মাতৃভাষা ছিল। কলিকাতা ব্যতীত বাঙ্গালা দেশের অপরাপর স্থানের মুসলমানেরাও যেপূর্ব্বাপর বাঙ্গালা ভাষার প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করিয়া আসিতেছেন, যশোহরে: “নবম-বঙ্গীয় সাহিত্য-সম্মেলন”-সভায়, আমিমুসলমান বঙ্গ সাহিত্যশীর্ষক প্রবন্ধে তাহা সপ্রমাণ করিয়াছি। কলিকাতা সহরের পঞ্চম শ্রেণীর পৃথক পৃথক শাখার মুসলমানেরা বাঙ্গালা ভাষার সহিত কোনও প্রকার সম্বন্ধ না রাখার ফলে, তাঁহারা খাঁটী বাঙ্গালী মুসলমানদিগের নিকট সম্মান প্রতিপত্তি লাভ করিতে পারিতেছেন না। পরন্তু তাঁহারা খাঁটী উর্দুভাষাভাষীদিগের দলেও সম্পূর্ণরূপে মিশিতে পারিতেছেন না। তাঁহাদের এখন উভয় সঙ্কট হইয়াছে। বাঙ্গালা ভাষার বর্ণমালার সহিত তাঁহারা সম্পূর্ণরূপে অপরিচিত থাকায়, দিকে অগ্রসর হইতে সাহস কুলাইতেছে না। পরন্তু ভাঙ্গা-উর্দুর কল্যাণে তাঁহারা বিশুদ্ধ উর্দু ভাষা শিক্ষা করা সহজসাধ্য বলিয়া মনে করিতেছেন। এই কারণে তাঁহারা বিগত ১৮৯০ খৃষ্টাব্দ হইতে ক্রমে ক্রমে উর্দু ভাষার পক্ষপাতী হইয়াছেন।

বিগত ১৮৯০ খৃষ্টাব্দে কলিকাতার টাউনহলে এক সভা হইয়াছিল। সভা-আহ্বানকারীরা যে প্রায় সকলেই পূর্ব্বোক্ত পঞ্চম শ্রেণীর প্রথম শাখা শ্রেণীর মুসলমান ছিলেন, তাহা বলাই বাহুল্য। উক্ত সভায় মোট তিনটী মন্তব্য গৃহীত হইয়াছিল। আমরা নিম্নে প্রথম প্রস্তাবটী উদ্ধৃত করিয়া দিতেছি। যথা ভারতের মুসলমানদিগের মাতৃভাষা উর্দু। সুতরাং এই সভা ভারত সাম্রাজ্যের অন্তর্গত বঙ্গপ্রদেশের মুসলমানদিগের মধ্যেও উর্দু ভাষার প্রচলন আবশ্যক বলিয়া মনে করেন, এবং এই সভা বঙ্গপ্রদেশের মুসলমান নেতৃবৃন্দকে এই কার্য্যে সহায়তা করিবার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করিতেছেন। যিনি সেই সভায় এই প্রস্তাবটী উপস্থাপিত করিয়াছিলেন, তিনি এক জন শ্রদ্ধাভাজন বাঙ্গালী মুসলমানের বংশধর। তিনি বলিয়াছিলেন, “যে বা যাহারা বাঙ্গালা ভাষাকে মাতৃভাষা বলিয়া স্বীকার করে বাঙ্গালা ভাষায় কথাবার্ত্তা কহে, তাহারা মুসলমান নহে।আমি প্রকাশ্য সংবাদপত্রে একাধিকবার বিবিধ যুক্তিতর্ক দ্বারা তাঁহার এই উক্তির খণ্ডন প্রতিবাদ করিয়াছি। অতঃপর কলিকাতা সহরে আরও কয়েকবার সম্বন্ধে আলোচনা হইয়া গিয়াছে। কিন্তু আলোচনাকারী মহোদয়েরা বিশেষ কোনও সুফল প্রাপ্ত হয়েন নাই। তাঁহাদের এই চেষ্টা বরাবরই বন্যার প্রবাহে তৃণখণ্ডের ন্যায় ভাসিয়া গিয়াছে। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, বারংবার অকৃতকার্য্য হইয়াও তাঁহারা হতাশ বা ভগ্নোদ্যম হয়েন নাই। সম্প্রতি তাঁহারা আবার নূতন করিয়া এই আন্দোলনের আরম্ভ করিয়াছেন।

কিছু দিন হইল, ঊর্দু ভাষা সাহিত্যের উন্নতির জন্য ভারতের বর্ত্তমান রাজধানী দিল্লী নগরে এক ঊর্দু সাহিত্য-সভা স্থাপিত হইয়াছে, এবং কলিকাতাতেও উহার একটি শাখা সভা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। গত পূজাবকাশের সময় এই সভার পক্ষ হইতে কয়েক জন প্রচারক বঙ্গদেশের বিভিন্ন জেলায় সভার উদ্দেশ্য প্রচার করিতে বাহির হইয়াছিলেন।  কলিকাতায় যে সভা স্থাপিত হইয়াছে, তাহার নাম হইয়াছে, “আঞ্জমন--তারাক্কিয়ে উর্দু-বাঙ্গালা।অর্থাৎ, বাঙ্গালা দেশের মুসলমানদিগের [মঙ্গলের] জন্য, উর্দু ভাষার উন্নতিবিষয়িণী সভা। সভার সভাপতি হইয়াছেন, দিল্লী-নিবাসী কলিকাতা-প্রবাসী বিখ্যাত সিগারেট-সওদাগর, হাজী বক্শ্ ইলাহী সাহেবের অন্যতম পুত্র, আমাদের প্রিয় বন্ধু মিঃ আব্দর রহিম বক্শ্ ইলাহী ; আর সম্পাদক নির্ব্বাচিত হইয়াছেন, আমাদের শ্রদ্ধেয় বন্ধু মৌলভী ওয়াহেদ হোসেন সাহেব, বি-এল, উকীল। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, যে সভা বাঙ্গালা দেশের বাঙ্গালী মুসলমানদিগের জন্য স্থাপিত হইল, তাহার কোনও সংবাদই বঙ্গদেশের অধিবাসীদিগের মধ্যে শতকরা ৫২ জন মুসলমানকে জানান হইল না ; অথচ সভা স্থাপিত হইল ! দুই চারি জনখোষ-খেয়ালীখোষ-মেজাজী' লোকে যাহা করিবেন, বাঙ্গালা দেশের মুসলমান অধিবাসিবর্গ যেজো-হুজুর' 'হাঁ-হুজুরবলিয়া অবনতমস্তকে তাহা স্বীকার করিয়া লইবেন, ইহা কখনই সম্ভব নহে।

প্রিয় বন্ধু মিঃ আব্দর রহিমের মাতৃভাষা উর্দু, সুতরাং তাঁহাকে একটি উর্দু সাহিত্য- সভার সভাপতির পদ গ্রহণ করিতে দেখিয়া আমরা প্রীতিলাভ করিয়াছি। কিন্তু বন্ধুবর মৌলভী ওয়াহেদ হোসেন সাহেবকে কোনও দিনও আমরা এই প্রকার উর্দু সাহিত্য-সভার সম্পাদক- রূপে দর্শন করিবার আশা করি নাই। কারণ, আমরা জানি, তিনি খাঁটী বাঙ্গালী। কোন্ ভাষা বাঙ্গালী মুসলমানদিগের মাতৃভাষা হওয়া উচিত, এবং বাঙ্গালী মুসলমানেরা কোন্ ভাষাকে স্বীয় মাতৃভাষার স্থলাভিষিক্ত করিলে তাঁহাদের মঙ্গল হইবে, সে চিন্তা বাঙ্গালার খাঁটী বাঙ্গালী মুসলমানদিগের পক্ষেই স্বাভাবিক, এবং সেরূপ চিন্তা তাঁহারা করিয়াও থাকেন। মুনশী মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী মরহুম, শাহ গরীবউল্লা মরহুম, মৌলবী সৈয়েদ হামজা মরহুম, সৈয়েদ আলাওয়াল মরহুম, মৌলভী সৈয়েদ হামিদুল্লা মরহুম, কাজী দৌলত মরহুম, পণ্ডিত আব্দল হাকিম মরহুম, মীর মোশারফ হোসেন মরহুম, মুনশী মোহাম্মদ মেহেরউল্লা মরহুম, নওয়াব সৈয়েদ নওয়াব আলী চৌধুরী খানবাহাদুর, মুনশী মোহাম্মদ রেয়াজদ্দিন আহমদ, মুন্শী শেখ আব্দল রহিম, মুনশী আব্দর হামিদখান, ইউসফজাই মরহুম, মৌলভী নৈমুদ্দিন মরহুম, মুনশী আব্দল কাদের মরহুম, মুনশী গোলাম মওলা সিদ্দিকী, মুনশী আব্দল করিম সাহিত্যবিশারদ, মুনশী মোজাম্মেল হক কাব্য-কণ্ঠ, মৌলবী মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মৌলবী মোহাম্মদ মণির উজ্জমান, মৌলভী রেয়াজদ্দিন, মৌলভী একিউদ্দিন আহমদ, মুনশী আব্দল লতিফ, মুনশী মোহাম্মদ কে, চাঁদ, মুনশী ফজলুল করিম, মৌলভী কাজী ইমদাদুল হক, মুশী ইসমাইল হোসেন সেরাজগঞ্জী, মৌলভী মোহাম্মদ শহীদুল্লা, মুনশী রওশন আলী চৌধুরী, মৌলভী ইয়াকুব আলী চৌধুরী, মৌলভী ওলিমউদ্দিন আহমদ, মুনশী কায়কোবাদ, মৌলভী মোহাম্মদ মোজাম্মিল হক্, মুনশী আব্দল মালেক চৌধুরী, মুনশী আব্দল জব্বার, শ্রীমতী মিসেস্ আর, এস, হোসেন, শ্রীমতী ফাতেমা খানম্, শ্রীমতী জোহরার রহমান, শ্রীমতী আজিজুল্ নিসা প্রভৃতি সাহেবান্ সাহেবানীগণ বাঙ্গালা ভাষাকেই বাঙ্গালী মুসলমানদিগের মাতৃভাষা বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন।

গত পূৰ্ব্ব চৈত্র মাসে বর্দ্ধমান সহরে বঙ্গীয় মুসলমান শিক্ষাসমিতির যে অধিবেশন হইয়াছিল, তাহাতেও বিষয়ের আলোচনা হইয়াছিল। বাঙ্গালা ভাষাই যে বাঙ্গালী মুসলমানদিগের মাতৃভাষা, সে কথা উক্ত শিক্ষা-সমিতিও স্বীকার করিয়াছেন। এমন কি, উক্ত শিক্ষা-সমিতিতে বঙ্গীয় মুসলমানদিগের জন্য জুমা ঈদের খোত্ত্বা যে বাঙ্গালা ভাষায় লিখিত পঠিত হওয়া উচিত, এই মৰ্ম্মে এক মন্তব্যও গৃহীত হইয়াছিল। ইহা ব্যতীত, বঙ্গীয় মুসলমান শিক্ষা-সমিতির কর্তৃপক্ষ কলিকাতা বঙ্গদেশের অপরাপর মাদ্রাসা-সমূহে বঙ্গ ভাষা শিক্ষা দিবার জন্য শিক্ষাবিভাগের কর্তৃপক্ষের নিকট একাধিকবার অনুরোধও করিয়াছেন। এমন অবস্থায় বাঙ্গালী মুসলমানদিগের মাতৃভাষাবাঙ্গালা ভাষাকে পরিবর্জ্জন করিয়া, ঊর্দু ভাষাকে তাহার স্থলাভিষিক্ত করিবার সার্থকতা আমরা উপলব্ধি করিতে পারিতেছি না .......

. মওলানা আব্দল খালেক, নদীয়া জেলার জুনিয়াদহ গ্রামের বিখ্যাত কাজী বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। বাল্যকালে ইনি গ্রাম্য পাঠশালায় বাঙ্গালা শিক্ষা করেন। পরে কলিকাতায় আসিয়া আরবী পার্শী ভাষা শিক্ষায় প্রবৃত্ত হয়েন। কিছুদিন কলিকাতায় বিদ্যাশিক্ষা করিয়া, পরে দিল্লী দমন করেন, এবং সেখানে মওলানা উপাধি প্রাপ্ত হয়েন। অনেক দিন তিনি দিল্লীরকোতাবখানা অধ্যক্ষ ছিলেন। সিপাহী-বিদ্রোহের পর তিনি কলিকাতায় আইসেন, এবং কলিকাতা মাদ্রাসার অধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত হয়েন। কিছুদিন এই পদে কার্য্য করিয়া, চাকরীতে ইস্তফা দেন, এবংরাদ' নামক একখানি পার্শী বাঙ্গালা মাসিকপত্র বাহির করেন।রাদ্ বৎসরের পর ১৮৮৪ সালে বন্ধ হয়। ১৮৮৫ সালে তিনি পুনরায়মোহাম্মাদীনাম বাঙ্গালী- উর্দূ ভাষায় এক সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। ১৮৯০ সালে মোহাম্মাদী বন্ধ হয়। আমরা পৃথক প্রবন্ধে সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করিব।

. হাজী আব্দল রাজ্জাক, মওলানা আব্দল খালেক মরহুমের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ছিলেন। ইনি মুসলমানী ধর্ম্মপুস্তক বিক্রয়ের ব্যবসায় করিতেন।

. শিয়ালদহ ষ্টেশনের, পূর্ব্বদিকে খালের ধারে যে প্রকাণ্ড জামে মসৃজিদ্আজিও বৰ্ত্তমান আছে, উক্ত মজিদ ১১৭৩ বঙ্গাব্দে নিৰ্ম্মিত হইয়াছিল। ইহার পূর্ব্বে কলিকাতায় কোনও পাকা মজিদ্ নিৰ্ম্মিত হয় নাই, এবং এরূপ প্রকাণ্ড মসজিদ্ কলিকাতায় দ্বিতীয় ছিল না এবং নাই। মুনশী কেতাবদ্দিন নামক এক ব্যক্তি এই মসজিদ প্রতিষ্ঠিত করেন। মুনশী মতিয়ার রহমান উক্ত কেতাবদ্দিনের পৌত্র ছিলেন। শিয়ালদহ ষ্টেশন গৃহ আফিসাদি যে জমীর উপর স্থাপিত হইয়াছে, সমস্ত জমী উক্ত মসজিদেরওয়াক্বফ' সম্পত্তি ছিল। মতিয়ার রহমানের বাবুগিরির ফলে এই সম্পত্তি নষ্ট হইয়াছিল। কলিকাতার মধ্যে ১৪০ বিঘা জমী উক্ত মসজিদের নামেওয়াক্বফ' করা ছিল।

. কলিকাতার যে অংশে এখনগ্যাস-হাউস' বৰ্ত্তমান, ঠিক স্থানে শরিফবাবুদিগের ভিটা ছিল তাঁহাদের বাহাদুরী কাষ্ঠের গোলা জমীদারী ছিল। পঞ্চ মকারের সাধনায় শরীফবাবুর যথাসর্ব্বস্ব নষ্ট হয়। শরীফবাবু বলিতেন, তাঁহার প্রপিতামহের সময় হইতে তাঁহারা কলিকাতার অধিবাসী। শরীফবাবুর পিতা মরহুমের সময় হইতে তাঁহাদের অবস্থার উন্নতি হইতে আরম্ভ হয়, এবং শরীফবাবু তাহার ধ্বংসসাধন করেন। গ্যাস-ঘর প্রস্তুতের সময় তাঁহারা সে ভিটা বিক্রয় করেন, এবং পূর্ব্বোক্ত মসজিদের অনতিদূরে একখণ্ড জমীর উপর, বাড়ী প্রস্তুত করিয়া বাস করিতে থাকেন। আমি সে বাড়ী দেখিয়াছি। তত বড় সুন্দর বাড়ী এখন আর বড় একটা দেখা যায় না। এখন সে বাড়ী নাই।

. মুনশী গোলাম রহমান পূর্ব্বোক্ত কেতাবদ্দিনের পৌত্র ছিলেন। তিনি পুলিসের দারোগাগিরি করিয়া পেন্সিয়ান প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। তিনি দারোগা বকাউল্লার সহকারী ছিলেন। কথিত আছে যে, তাঁহারই জন্য দারোগা বকাউল্লার এত নামডাক হইয়াছিল। কারণ, তিনি সর্ব্বদাই আত্মগোপন করিয়া চলিতেন, এবং দারোগা বকাউল্লা সেই সুযোগে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিলেন।

. মুনশী মিনহাজদ্দিন শিয়ালদহ ম্যাজিষ্ট্রেট কোর্টে মোক্তারী করিতেন। তিনি এক জন প্রতিভাশালী মোক্তার ছিলেন। তিনিও কলিকাতায় অনেক ভূসম্পত্তি করিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার বংশধরেরা মোকদ্দমা-মামলায় সমস্ত উড়াইয়া দিয়া এখন পথের ভিখারী হইয়াছেন।

. মুনশী ইম্তিয়াজ আলী পূর্ব্বে কি করিতেন, জানি না। কিন্তু যে সময়ের কথা বলিতেছি, তখন তিনি পূর্ব্ববঙ্গ রেল-আফিসের কেরাণী ছিলেন।

. শেখ আহমদ ওরফে আমু ওস্তাগার কলিকাতা কেল্লার দর্জ্জিখানার প্রধান কর্ম্মাধ্যক্ষ ছিলেন।

. মুনশী মণিরউদ্দিন আহমদ পুলিসের জমাদার ছিলেন। সে সময়ের কথা বলিতেছি তখন তিনি পেন্সিয়ান ভোগ করিতেন। জমাদারী কার্য্যে তিনি বেশ সুনাম অর্জ্জন করিয়াছিলেন।

১০. মরহুম একটি সাঙ্কেতিক শব্দ। মৃত ব্যক্তিদিগের নামের শেষে এই শব্দ ব্যবহৃত হয়। হিন্দুরা যে ক্ষেত্রে এই সাঙ্কেতিক চিহ্ন ব্যবহার করিয়া থাকেন, মুসলমানেরা সেই ক্ষেত্রেমরহুমশব্দ ব্যবহার করেন। মৌলবী ইম্তিয়াজ আলী কলিকাতা মাদ্রাসা কলেজের অন্যতম অধ্যাপক ছিলেন। তিনি কিছু দিন চাকরী করিয়া, ইস্তফা দিয়াছিলেন।

১১. এখন তাঁহাদের বংশধরেরা উক্ত মহাল্লায় বাস করেন না; নারিকেলডাঙ্গা নর্থ রোডে বাস করিতেছেন।

১২. ইংরাজী-শিক্ষিত মুসলমানদিগকেও আজ কালমৌলবীবলা হইতেছে। মৌলবী লিখিলে কে আরবী-ফার্সীর মৌলবী কে ইংরাজীর মৌলবী, তাহা বুঝিবার উপায় নাই। তাই আমরা আরবী ফার্সী ভাষায় পণ্ডিতদিগকেমৌলবী ইংরাজীভাষাতিজ ব্যক্তিদিকেমৌলভীলিখিবার ব্যবস্থা করিয়াছি।

১৩. কাহারও কাহারও মতে, সম্রাট শাহজাহানের শাসনকালে, ভারতবর্ষের কয়েকটি প্রাদেশিক ভাষা আরবী-ফার্সী ভাষা হইতে কতকগুলি শব্দ লইয়া উর্দূ ভাষার সৃষ্টি হইয়াছিল।

১৪. ঢাকা মুর্শিদাবাদ-সিটী সহরদ্বয়ের অধিকাংশ মুসলমান অধিবাসীই ভাঙ্গা উর্দূ মাতৃভাষারূপে ব্যবহার করিয়া থাকেন। ইহার একমাত্র কারণ এই যে, উক্ত দুই স্থান মুসলমান আমলের শেষ সময় বাঙ্গালা, বিহার উড়িষ্যার রাজধানী ছিল। চট্টগ্রাম প্রভৃতি স্থানে যে সকল আরব পারস্যদেশবাসী সওদাগর, দরবেশ পরিব্রাজক আসিয়া বাস করিয়াছিলেন, তাঁহাদের বংশধরেরা এখন বাঙ্গালা ভাষাকে মাতৃভাষা বলিয়া স্বীকার করিয়া লড়য়াছেন। স্বর্গীয় পণ্ডিত আলাওল, কাজী দৌলত, মৌলবী হামিদুল্লা প্রভৃতি খ্যাতনামা কবিগণ ইহার দৃষ্টান্তস্থল।

১৫. বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকার ত্রয়োবিংশ ভাগের দ্বিতীয় সংখ্যার ৯৫ হইতে ১২২ পৃষ্ঠা পৰ্যন্ত দ্রষ্টব্য।

১৬. পরে জানা গিয়াছে যে, আজিও বঙ্গদেশে মধ্যে মধ্যে প্রচারকদিকে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু শ্রোতার অভাবের জন্য তাঁহাদের প্রচার কার্য্যে বাধা উপস্থিত হইতেছে।

১৭. আমরা বিশ্বস্তসূত্রে অবগত হইলাম যে, বন্ধুবর মৌলভী ওয়াহেদ হোসেন সাহেব আমাদের এই প্রবন্ধের বিষয় অবগত হইয়া, এবং নিজের ভ্রম বুঝিতে পারিয়া, উর্দু সাহিত্যসভার সম্পাদকের পদ ত্যাগ করিয়াছেন। ইহা অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ, সন্দেহ নাই। যে খোদা তাঁহাকে সুমতি দিয়াছেন, তিনি তাঁহার মঙ্গল করুন। আমিন!

১৮. মৌলভী ওয়াহেদ হোসেন সাহেব বরাবরই বঙ্গভাষার অনুরাগী। উর্দু সাহিত্য-সভার সম্পাদকের পদ গ্রহণ করিবার পূর্ব্বে তিনি যে যে ভাবে বঙ্গসাহিত্যের অনুশীলন করিয়াছিলেন, এই প্রবন্ধমধ্যে আমরা সেই সকল ঘটনা উদ্ধৃত করিয়াছিলাম। কিন্তু তিনি তাঁহার ভ্রমসংশোধন করায়, তাহা পরিত্যক্ত হইল।

প্রবন্ধটি বাকীপুরের দশম বঙ্গীয় সাহিত্য সভায় পঠিত। আজকের বাঙলা ভাষার দীনহীন অবস্থার পক্ষে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এই প্রবন্ধটি সংগ্রহ করে দিয়েছেন গবেষক পরিত্রাতা বন্ধুবর অশোক উপাধ্যায়। তাঁর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।

বাঙলা দেশের মুসলমানের বাঙলা :

 

বাংলাদেশের সাহিত্যের ভাষারীতিতে কোনরূপ গুরুত্বপূর্ণ নয়া বাঁক দেখা যাচ্ছে কি না এবিষয়ে এই বঙ্গের পণ্ডিত মশায়দের কোন ভাবনা-চিন্তা আমার চোখে পড়েনি। বাংলাদেশেও কোনরূপ আলোড়ন হয়েছে বলে জানা নেই। কিন্তু বারবার বাংলাদেশে যাবার সুবাদে এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিক্ষক, লেখক বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ফলে এই বিষয়ে আমার বলার মত কিছু জরুরি কথা জমে গেছে। আমি জানি কথাটা তুললেই অনেকে আমার সঙ্গে একমত হবেন যে বাংলা চলিত ভাষা নিয়ে দুই বাংলার ব্যবহারে ফারাক দেখা দিচ্ছে।

বাংলা চলিত ভাষা সর্বজনীন হয়ে উঠল কি ভাবে সে কথা সকলেরই জানা। বাংলা লেখার একটা আদর্শ গদ্যরীতি যখন প্রবর্তিত হল, যাকে আমরা বলি সাধুগদ্য, তখন একটা কথা উঠল ভাষা বেশ কঠিন, সর্বসাধারণের বোঝবার উপযোগী নয়। যদিও বিদ্যাসাগর মহাশয়ের লেখায় যখন সাধু গদ্য একটা বাঁধা চেহারা নিল, তখন কলকাতা অঞ্চলের কথ্যভাষার মূল ভিত্তিটা তিনি মনে রেখেছিলেন। তবে তার উপরে বাড়াবাড়ি রকম সংস্কৃত শব্দের ওজন এবং সমাসবদ্ধ পদের আড়ম্বর এসে চেপে বসায় সে ভাষা অতিরিক্ত ভারী হয়ে পড়েছিল। লোকের মুখের ভাষা থেকে তা অনেক দূরের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সর্ববোধ্য ঢঙ, মুখের ভাষার নৈকট্য আনবার চেষ্টায় প্যারীচাঁদ মিত্র কলকাতায় ব্যবহৃত কথ্য ভাষাকে ঘষেমেজে বিদ্যাসাগরী আদলের সঙ্গে খানিক আপোস করে বই লিখলেন। আর কালীপ্রসন্ন সিংহ আপোসে না গিয়ে, মাজাঘষা না করেই কলকাতার কথ্য ভাষাকে পুরো তুলে আনার চেষ্টা করলেন লেখায়। তা হল লোকের মুখের ভাষার কাছাকাছিএর মানেটা হল কলকাতার লোকের মুখের ভাষার কাছাকাছি। মেদিনীপুর বা কুমিল্লার লোকের কথ্য বুলির কাছাকাছি নয়। নাটক, বিশেষ করে প্রহসন লিখতে গিয়ে লেখকেরা আঞ্চলিক ভাষা সংলাপে খুব ব্যবহার করতেন। বেশির ভাগ কলকাতাই কথ্যের, একেবারে ককনির মিশেল থাকত তাতে, যেমন একেই কি বলে সভ্যতায়, সধবার একাদশীতে, অমৃতলালের ব্যঙ্গ নাট্যে। কখনও গ্রামের কথ্য এসে যেত। এই সময়ে লেখায় মূলত সাধুই চলত। বিদ্যাসাগরী সাধু ক্রমে সরল হয়েছে। হতে হতে দেখি শরৎচন্দ্রের ভাষার কাঠামো সাধু হলেও সরল সুবোধ্য-চলিতের সঙ্গে পার্থক্য অল্প। শুধু ক্রিয়াপদে আর সর্বনামে। তার উপরে এই সময়ের লেখকেরা সবাই প্রায় সংলাপে চলিত চালাতেন। সেটা ঠিক প্রহসনের সংলাপ বা হুতোমি বুলি নয়। এর পরে একটা আন্দোলন দেখা দিল রবীন্দ্রনাথ তাতে মদত দিলেন। সব রকম গদ্যের ভাষা হোক চলিত। আন্দোলন হলেও পুরোপুরি চলিত চলতে আরও সময় লেগেছে। স্বাধীনতার পরেও বেশ কিছুদিন। বিশেষ করে প্রবন্ধের বেলাতে। এই চলিতের ভিত্তি কি?

 

. কেউ বলেন চলিত শান্তিপুর-কৃষ্ণনগরের মুখের ভাষার আদলে গড়ে ওঠা ভাষা। দেশে এত জায়গা থাকতে শান্তিপুরী ভাষাকে মডেল করবে কে? কেন? বুলি নাকি বহুৎ মিঠা উচ্চারণে শুদ্ধ। কথাটা যুক্তির নয়। আমরা জানি নিজের এলাকার কথ্য ঢঙই সকলের কানে সবচেয়ে মধুর। তা ছাড়া ভাষার মিষ্টতা কর্কশতাএটা একটা নান্দনিক বোধ, নিয়ে ফৌজদারি গড়ালেও ফয়সলা হবে না। আর উচ্চারণে বিশুদ্ধি ব্যাপারটা বড় গোলমেলে। শম্ভু মিত্র ভাল অভিনেতা বলে পদ্ম-এর বাংলা উচ্চারণ পদ্দ ভুলে যদি পদ্ বলেন তাকে শুদ্ধ বলতে পারব না। বিলিতি স্কুলে পড়া অনেক ফ্যাসানি মেয়ে দাঁতে চেপে ইংরেজিতে বাংলা বলে, সেটাকেও হাস্যকর বিকৃতিই বলব। কিন্তু যখন নোয়াখালির ছাত্রটি পরীক্ষা দিয়ে এসে বলবেএবারে ফাস খরবার ফারি'—তাকে অশুদ্ধ বলব কোন আইনে? বাংলাদেশী ফৌজি রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান ফতোয়ায় বলেছিলেন পূর্ববঙ্গযা এখন বাংলাদেশ, তার বাংলাই শুদ্ধ অবিকৃত, পশ্চিমে পুবে উত্তরে যে বাংলা ব্যবহৃত তা বিকৃত, অশুদ্ধ। এই নিয়ে অকারণ লড়াইটা বন্ধ রাখা যাক। আসলে শুদ্ধতার খাতিরে নয়, মাধুর্যের সন্ধানে নয়, একটা সর্বমান্য কথ্য রীতির প্রয়োজনে চলিত গড়ে উঠেছিল লোকের মুখেমুখে। তাই এত জেলা বাদ দিয়ে নদের উপর বরাত পড়ার কারণ তো খুঁজে পাওয়া যায় না।

. আর একটি মত, বাংলার মান্য কথ্য অর্থাৎ স্ট্যাণ্ডার্ড কলোকিয়াল যাকে আমরা বলি চলিত তৈরি হয়ে উঠেছিল বিভিন্ন অঞ্চলের কথ্যের তিল তিল উত্তম অংশ সংকলন করে। এই মতটিও অগ্রাহ্য করতে হয়। কোন সামাজিক-ভাষা-বিজ্ঞানীই স্ট্যান্ডার্ড ভাষা গড়ে ওঠার পিছনে এরকম তিলোত্তম তত্ত্ব দেখতে পাননি, আর উত্তম নিয়ে যখন কোন যুক্তিসহ সিদ্ধান্তে পৌঁছনই সম্ভব নয়। তাছাড়া কয়েকজন ভাষাতাত্ত্বিক বৈয়াকরণ মিটিং করে বাছাই ঝাড়াই করে বাংলা চলিতের পত্তন করেছিলেন এমন কথা নিশ্চয়ই কোন স্বাভাবিক বুদ্ধির মানুষ ভাববে না।

. একটি বিশেষ অঞ্চলের মানুষের কথ্যই ভিত্তি হিসেবে থাকে এসব ক্ষেত্রে। সেই স্থানিকতা কেউ বেছে দেয় না। সামাজিক-ঐতিহাসিক কারণে তা নির্ণীত হয়। পণ্ডিতেরা বলেন বিদ্যাসাগরী সাধু গদ্যের ভিতও ছিল কলকাতার কথাই। কলকাতার কথ্যই বাংলা চলিতেরও ভিত। শুধু ভিত নয়, দেহের অনেকটাও। তার সঙ্গে অন্য অঞ্চলের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়েছে। বিবেকানন্দ লিখেছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ-অমৃতলাল বোসের মত সুতানটি করুনি কথ্যে। রবীন্দ্রনাথ প্রবাস থেকে ডায়েরি ইত্যাদি লিখেছিলেন কলকাতা কথ্যের সঙ্গে কিঞ্চিত যত্তরে মিশিয়ে পিরালি ঠাকুর বাড়ির বউয়েরা সব আসত দেশ থেকে কি না। পরবর্তী কালে প্রমথ চৌধুরী তাঁর নান্দনিক বোধে নদে শান্তিপুরী মিশেল দিতে চেয়েছিলেন। আর দেশভাগের পরে পুব বাংলার উদ্বাস্তুর বন্যায় সমকালীন কলকাতাই চলিতে গাঢ় বাঙাল রঙ আর ঢঙ এসে গিয়েছে। সোসিও-লিঙ্গুরিস্ট গবেষকেরা একটু খোঁজখবর করলে বিষয়ে আরও ভাল করে বলতে পারবেন। চলিত চালু করার বিরুদ্ধে একটা বড় যুক্তি ছিল, কলকাতা এবং আশেপাশের লোকেরা ছাড়া অন্য বাঙালিদের কাছে এই ভাষা কাছের নয় বরং সাধুভাষার চেয়েও অপরিচিত। তবুও কলকাতা-ভিত্তিক চলিতই পরিচিত হয়ে উঠল এবং চলল।

                                            এই চলিত লেখায় আসার অনেক আগে কথা বলায় এসে গিয়েছিল। ঠিক কতকাল আগে থেকে সে ইতিহাস আমার জানা নেই, কিন্তু লেখার গদ্যে সর্বজনীনভাবে চলিত এসে যাবার বহুকাল আগে সারা বঙ্গদেশে শিক্ষিত সমাজে সভাশোভন ভাষা হিসেবে, এবং বোধ হয় তার বাইরে ব্যবসা-বাণিজ্য-প্রশাসনের প্রয়োজনে এই ভাষা ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। মধুসূদন গিরিশবাবুর নাটকে, শুধু প্রহসনে নয়ঠিক সাধুর ব্যবহার চলত না। ক্রিয়াপদ সর্বনাম পদগুলি কলকাতার উচ্চারণের মত। ভেতরটাও বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমের গদ্যের মত নয়। কিঞ্চিৎ কথ্য ঘেঁষা।

কলকাতা তখন সারা বঙ্গের রাজধানী। ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র, শিক্ষার সংস্কৃতির আশ্রয়। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে যারা শিক্ষিত, ধনবান, সরকারী কর্তাব্যক্তি, তারা কলকাতার কথ্যকে বহন করে নিয়ে গেছে অবিরত। মানুষের চলমানতা যত বেড়েছে তত স্বাভাবিক কথ্যের পাশে একটা সর্বমান্য কথ্যের ব্যবহার শুরু হয়েছে।

সাহিত্যে আংশিক প্রবেশ করলেও মানুষের প্রয়োজনে সারা বঙ্গেই কলকাতা চলিতের প্রবর্তন হয়েছে। স্কুলের মাস্টারমশাই ক্লাসে পড়াতেন চলিতেবাঁকুড়ায় কিংবা রংপুরে। বাঁকুড়ার শিক্ষক বাড়িতে বা বাজারে এমনকি নিজেদের তাসের আড্ডায়ও নিজস্ব অঞ্চলের কথ্যই ব্যবহার করতেন। খুলনায় কিংবা কোচবিহারে রাজনৈতিক জনসভায়, রবীন্দ্র-জয়ন্তীতে বা ধর্মব্যাখ্যার আসরে চলিতেই চলত কথা, আদালতে সওয়াল। কাছেই পানের দোকানে ভাষা বদলে যেত বা মক্কেলকে বোঝাবার সময়ে নিজের জেলাওয়ারিআরও সংকীর্ণ', এলাকা-মাফিক বুলি নির্বিবাদে দখল নিত। এঁরা সবাই আবার লেখার সময়ে সাধুতে লিখতেন। কারণ চলিতে লেখা তখনও ট্যাবু। কিন্তু ট্যাবু আর রইল না, দেশভাগের ২৫ বছর আগেই প্রমথবাবুদের চেষ্টায় নাট্যসংলাপ ব্যতীত অন্যত্র, এমন কি গুরুগম্ভীর প্রবন্ধেও যখন বেশ কিছুটা চলিত চালু হল লোকের কাছে তা অপরিচিত গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে হল না। মুসলমান ভদ্রলোকেরা আরও খুশি হলেন সংস্কৃতের অকারণ খবরদারি কতক কমল বলে। আমরা যখন দেশভাগের আগে পড়াশুনা করতে কলকাতায় এলাম, এখানকার চলিত ঠিকঠাক রপ্ত করতে সময় লেগেছিল। বাংলার মহাপণ্ডিত সুধীর দাশগুপ্তকে দেখেছি বরিশাল্যা ঢঙে কলকাত্তাই বলে গেলেন আজীবন। শ্রীকুমারবাবুর মত জ্ঞানতাপস বীরভূমি উচ্চারণ ছাড়তে পারলেন না। শশিভূষণ দাশগুপ্ত আঞ্চলিক উচ্চারণ ঢাকতে বাড়তি চন্দ্রবিন্দুর আমদানি করতেন দেদার। কিন্তু কলকাতার চলিত চাইচট্টগ্রামের বা রাজশাহীর, পুরুলিয়ার বা জলপাইগুড়ির, সারা বাংলার শিক্ষিত মানুষের। যদিও এঁদের অধিকাংশই লেখার ভাষা রূপে মানতেন সাধুকে। কিন্তু ব্যাপকভাবে এমনকি সর্বমান্য শক্তিতে চলিতের আগমনের জন্য তাঁরা তৈরি হয়েই যেন ছিলেন। প্রশ্ন হতেই পারে কেন কলকাতাই চলিতের প্রতি এত ব্যাপক আনুগত্য ? কারণ কলকাতাই হয়ে উঠেছিল বাঙালির জীবন মানস সরোবরের শতদল পদ্ম।

                                               দেশবিভাগ হবার পরে কলকাতার সেই ভূমিকা আর অবিচল নেই। কলকাতা এখনও বাংলা ভাষা সংস্কৃতির কেন্দ্রশুধু ভারতীয় বাঙালির ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের সঙ্গে কলকাতার সম্পর্ক ইতিহাসের। গত ৫৩ বছরে ঢাকা পূর্ববঙ্গের বাঙালির মনে কলকাতার স্থান দখল করেছে। জি আজ ব্যবহারিক প্রয়োজন সিদ্ধ করার দিক থেকে সারা বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগের কেন্দ্ররূপে ঢাকার গুরুত্ব। মেট্রোপলিটন মহানগরীরূপে তার দ্রুত বৃদ্ধি বাংলাদেশীদের কাছে তাকে গর্বের গৌরবের আসনে উন্নীত করেছে। ঢাকাকে আশ্রয় করেই ওদের নবজাগ্রত এবং ত্বরিত গতিতে বিকশমান জাতিসত্তা সর্ববিধ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকাণ্ড সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, তথা সারাদেশের ক্রিয়াকাণ্ডকে এই নগরীর অভিমুখিন করেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের সেন্ট্রিফুগাল সেন্ট্রিপেটাল ফোর্সের এপিসেনটার ঢাকা। ঊনবিংশ শতকের গোড়া থেকে অখণ্ড বঙ্গে কলকাতা ঠিক তাই ছিল। এই কারণে বর্তমানে সারা পূর্ববঙ্গে কাজ চালাবার মত একটা সর্বগ্রাহ্য কথ্যের অর্থাৎ একটি স্ট্যাণ্ডার্ড কলোকিয়ালের দরকার হয়ে পড়ল আর স্বভাবিকভাবেই তাতে ঢাকার কথ্য ভিত তৈরি করে দিল। আগের সর্ববঙ্গে প্রচলিত চলিত নিয়ে আর চলল না কেন? উপরে তার মুখ্য রাজনৈতিক পটভূমি বিবৃত করেছি। আর একটি মনস্তাত্ত্বিক কারণ হল, যতই কেন আগে সারা বাংলায় চলুক, ভাষা একান্তভাবে ভারতের, স্বাধীন পূর্বপাকিস্তান তাকে কিভাবে আর নিজের বলবে। মানসম্মানের ব্যাপার আছে। পাক-ভারত বৈরিতার সমস্যা আছে। হিন্দু-মুসলমানের প্রশ্নটিও একেবারে নেই এমন নয়। তা ছাড়া সারা পূর্ববঙ্গে যে শিক্ষিত বাঙালি সভাশোভন ভাষারূপে চলিত চালাত, তার বেশির ভাগ হিন্দু দেশত্যাগ করেছে। নতুন যে মুসলিমেরা শিক্ষিত হয়ে উঠছে তাদের কাছে এই কলকাতাই চলিত দূরের অপরিচিত। এবং সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটতে শুরু করেছেব্যবসা বাণিজ্য প্রশাসন প্রভৃতি ক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গে আন্তঃ জেলা সাধারণ কথ্য রীতির বিকাশ এবং যার ভিত্তিতে ঢাকার কথ্য। অবশ্য আমি যখন বলি ঢাকার কথ্য তখন সে ভাষা যে বাঙাল উপভাষার মধ্যে পড়ে তা বিশেষভাবে মনে রাখি। আর সেই কারণেও পূর্ববঙ্গের সব কথ্যের সঙ্গে তার অনেক নৈকট্য, রাঢ়ী উপভাষার বিভিন্ন লক্ষণ বহন করে কলকাতার চলিত যা নয় বাঙাল দেশের

সঙ্গে। দেশভাগের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গত ৫৬ বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় এবং আরও ক্ষুদ্রতর এলাকায় কথাবার্তায় ভাষা ব্যবহারের যে রীতি দাঁড়িয়েছে তা হল এই রকম। পটুয়াখালির একজন সাধারণ কৃষক দক্ষিণ বরিশাল্যা কথ্যে যা কিছু বলার বলছে। এখানকার উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক বা কাছারির উকিল তার কার্যস্থলে এক ধরনের মাজাঘষা কথ্যে পড়াবেন বা সওয়াল করবেন। সে ভাষা দক্ষিণ বরিশাল্যা কথ্য নয়। কথ্য ঠিকই, আবার পুরনো পরিচিত চলিতও নয়। আপনি কুষ্টিয়া চলে আসুন, দেখবেন সেখানকার চাষী উত্তর যশুরে কথ্য বলে আর কলেজে বা ময়দানের বক্তৃতায় মেয়া সাহেবেরা এমন একটা কথ্য বলেন যা আপনি পটুয়াখালিতেও শুনে এসেছেন। পাবনার হাটে বা গোয়ালন্দের গঞ্জে, বাজারেও কিছু কম পরিশীলিত হলেও ভাষাই চলছে। সেখানে জমায়েত কুমিল্লা চাটগাঁ রংপুরের লোক নিজ নিজ এলাকার স্বাভাবিক কথ্যে বলছেন না। নতুন আগন্তুক থাকলে বলছেন আপন এলাকার কথ্যে, তবে কিছুদিন ব্যবসা করতে আসার সুবাদে পূর্বোক্ত সর্বজনীন কথ্য তাঁরও রপ্ত হয়ে যাবে। পারস্পরিক বোঝাপড়ার জন্য একটা কাজ চলা গোছ, মোটামুটি একই ধাঁচের একটা সর্বমান্য কথ্য চালু হয়ে গেছে সারা বাংলাদেশে। এই ভাষার মূল আদল বাঙাল উপভাষা সাধারণভাবে, এবং বিশেষভাবে ঢাকাই কথা।

গত ৫৩ বছরে বাংলাদেশ মৌখিক ব্যবহারে একটা নিজস্ব স্ট্যান্ডার্ড কলোকিয়াল ভাষা প্রবর্তিত করেছে, যা অখণ্ড বঙ্গের চলিত থেকে পৃথক। অখণ্ড বঙ্গের সেই চলিতকে আমি বুঝবার সুবিধার জন্য নাম দিয়েছি কলকাতাই চলিতখানিকটা তার স্বভাব-চরিত্র বোঝাবার জন্যও বটে। নামটা সাময়িক। আমরা একে শুধু চলিত বলে জেনেছি, পরেও তাই বলে জানব।

                                            নিচে দুই বাংলার বর্তমান অব্যবহিত অতীতের ভাষাগত অবস্থান দেখান হল :

. সাধু গদ্যসমগ্র বঙ্গদেশের

. চলিত বাংলা [কলকাতাই চলিত]—সমগ্র বঙ্গের ১৯৪৭ পর্যন্ত।

. চলিত বাংলা [কলকাতাই চলিত]—শুধু এই বঙ্গের, ১৯৪৭-এর পর থেকে।

. চলিত বাংলা [ঢাকাই চলিত] — শুধু ওপার বাংলার, ১৯৪৭-এর পর থেকে। অর্থাৎ, এই বাংলায় : -- [ এবং এক এবং অবিচ্ছিন্ন ধারা।] বাংলায় : -- [ এবং -এদের মধ্যে একটা বাঁক আছে। এরা এক নয়, পৃথক।] বাংলাদেশে এই অন্য চলিতটি এখনও লেখায় প্রত্যক্ষত প্রচলিত নয়, কার্যত জীবনে প্রতিষ্ঠিত হলেও। চলিত ভাষা লেখায় সুনির্দিষ্ট রূপ নিয়ে সর্বজনীন হয়ে উঠতে, অন্তত বেশির ভাগ লেখায় ব্যবহৃত হতে যে অনেক সময় লাগে এবং তার জন্য যে সাহিত্যিক, এবং কিছুটা সামাজিক আন্দোলনেরও প্রয়োজন হয় তা আমরা আমাদের চলিত ভাষার ক্ষেত্রে দেখেছি। বাংলাদেশে এখনও সেই আন্দোলন হয়নি। তবে যে শ্লোগানে অবিভক্ত বঙ্গে চলিত রীতির পক্ষে আন্দোলন হয়েছিল, সেই একই যুক্তিতে অর্থাৎ কলকাতাই চলিতের বিরুদ্ধে ঢাকাই চলিতের পক্ষে আন্দোলন হবেই। তার বেশি দেরি নেই।

বাংলাদেশের বাঙালির নিজস্ব কথ্য চাই, তাতে লেখালেখি হওয়া চাই, এখন যা বিদেশ সেই রাঢ় এবং কলকাতার কথ্যের ভিতে দাঁড়ানো চলিতকে নিয়ে আগে কাজ চলেছে স্বাভাবিক অধিকারে, আর নয়, সেটা সম্মানজনকও নয়। তাই বাংলাদেশের নিজস্ব চলিতের জন্য আন্দোলন হবে। মৌখিক ব্যবহারে যে একটা জায়গা আপনি তৈরি হয়ে উঠেছে, লেখার ক্ষেত্রে তার কোন শিষ্ট রূপ চালু হোক, চালু হতেই হবে। কথ্য ভাষায় শুধু নয়, লেখ্য সাহিত্যেও কতক এই নতুন চলিতের ব্যবহার আমরা দেখছি। বিশেষভাবে সৃজনধর্মী সাহিত্যে, নাটকের সংলাপে, গল্পোপন্যাসের কথাবার্তায়, ক্বচিৎ বিবরণ-বর্ণনা অংশেও আমরা তার চিহ্ন দেখছি। প্রবন্ধে বা কবিতায় মাত্র কিছু শব্দ-প্রয়োগে। তবুও বলব, লেখা দেখে বলতেই হবে নতুন চলিত এখনও দূরে। সেক্ষেত্রে ব্যাপারটা এরকম,— পুরনো দিনে সাধু গদ্যে যখন সব লেখালেখি হত আর বলা হত অন্য ভাষায় সেরকম। তাই তো আন্দোলন হয়েছিললেখার ভাষাকে হতে হবে মুখের ভাষার মতন। বাংলাদেশে সেই আন্দোলন আসন্ন। তবে সে আন্দোলন শুরু হতে দেরি হবার কারণও আছে।

. এক সময়ে লিগপন্থীরা ভাষার ক্ষেত্রেও একটা স্বতন্ত্র মুসলমানী রীতি আনতে সচেষ্ট হয়েছিল বিভাগপূর্ব বাংলায়। সে ভাষারীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল আরবি-ফারসির নির্বিচার ব্যবহারে এবং ভাষার অতীত ইতিহাসকে, প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা থেকে তার উৎপত্তিকে অস্বীকার করার চেষ্টায় অস্বাভাবিক কিম্ভুত। বাংলাদেশ ষে বঙ্গভাষার মুক্তির জন্য লড়েছে, জীবন দিয়েছে তার সঙ্গে উক্ত মুসলমানী বাংলার কিছু যোগ ছিল না। গত ৫৩ বছরে বাংলাদেশ যে বাংলাভাষার সাধনা করেছে তার মধ্যে কোথাও ভিন্ন ভাষারীতির শ্লোগান ছিল না। বাংলার স্বাভাবিক ইতিহাসের প্রতি তার আনুগত্য ছিল কঠোর। তাই নতুন চলিতের জন্য আন্দোলন ভাষাক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতা বলে গণ্য হতে পারে, মৌলবাদীদের ভাষা-ভাবনাকে সাহায্য করতে পারে।

. উচ্চারণে বানানে ব্যাকরণে বাংলাভাষার বিশুদ্ধি এবং আভিজাত্য, তার অতীত বৈশিষ্ট্য রক্ষা করার কথা ওদেশের পণ্ডিতেরাও মনেপ্রাণে চেয়েছেন। তাই চলিতভাষাঘটিত যে অনিবার্য পরিবর্তন দেশব্যাপী দেখা দিয়েছে তা মেনে নিতে পারেননি।

. লেখকদের এবং ভদ্রলোকদের একটা স্তরের মধ্যে কিঞ্চিৎ হীনমন্যতা আছে বলে আশঙ্কা করি। আমরা যেমন প্রথম কলকাতা-জীবনে কলকাতাই ঢঙে চলিত বলতে পারতাম না, এবং সহপাঠী কলেজ পড়ুয়াদের কাছে 'বাঙাল' অভিধা শুনে লজ্জিত হতাম তেমনি আর কি। দেবব্রত বিশ্বাসের মত বুক ফুলিয়ে সর্বদা বাঙাল কথা বলার সাহস কোথায় পাব? জর্জ দাকে দেখছি পরক্ষণে শুদ্ধ রাঢ়ী উচ্চারণে রবীন্দ্র-সংগীত গান করতে এবং তার পরেই বাস ঢাকাই বুলিতে মেতে উঠতে। উনি এত বড় ছিলেন বলেই কি হীনমন্যতার প্রশ্ন ছিল না, অথবা উনি স্বভাবত তা থেকে মুক্ত ছিলেন। মাজাঘষা কলকাতাই বলাই বাংলা বলার চূড়ান্ত উৎকর্ষ বলে বাংলাদেশের কেউ কেউ ভাবেন। সে ভাবনাও এই সম্ভাব্য আন্দোলনকে পিছিয়ে রেখেছে। অথচ সামাজিক-রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ফলে ভাষা ক্ষেত্রে এই যে বদল হচ্ছে তা কোনরূপ জবরদস্তি ইসলামিকরণ নয়, বাংলাভাষার ঐতিহ্যের পক্ষে কিছু সর্বনাশা কাণ্ড নয়। এর পিছনে লিগারদের সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির অবশেষ নেই।

                                           বাংলাদেশে কথাবার্তায় যে অন্য রীতি এসে গেছে এবং লেখায় কোথাও কিছু কিছু আসছে তার ভাষাগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে কয়েকটি কথা বলব।

. ধ্বনি এবং রূপদুদিক থেকেই এই স্বাতন্ত্র্য দেখা দিয়েছে।

. কলকাতাই চলিতের ভিতে যেমন রাঢ়ী উপভাষা তেমনি ঢাকাই চলিতের ভিতে বঙ্গালী উপভাষা। যে কোনও উপভাষার অঞ্চলভেদে বিচিত্র রূপ। তার যে রূপ রাজধানীতে তথা শিক্ষা-সংস্কৃতির কেন্দ্রীয় শহরে প্রচলিত তাকে আশ্রয় করেই চলিতের আবির্ভাব তথা রূপ নির্মাণ

. অপিনিহিতির প্রচলন, অভিশ্রুতির অপ্রয়োগ। স্বরসংগতি দুর্লভ। আদ্যঅ্যা’- কেবলবেই ওরা।’, 'ড়'- মধ্যে ভেদ নেই। নাসিক্য উচ্চারণ কিছুটা স্বেচ্ছাচারী। পদেবলপ্রয়োগও অন্যরকম, দ্বিমাত্রিকতার নিয়ম সর্বদা মানতে চায় না। তিন’-এর ভেদ তো গোটা বাংলায় নেই, ওদের একেবারেই নেই।

. বিভক্তির ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রে আলাদা। কর্তায়’, য়হামেশাই চলে। সম্বোধনেঅ্যা’-এর ব্যবহার। অজস্র নতুন অনুসর্গ পদ। কিছু কিছু সাধু অনুসর্গ রেখে দেবার প্রবণতা। ক্রিয়াবিভক্তি বেশ ওলট-পালট। এক কালের ক্রিয়াবিভক্তি অন্য কালে প্রায়ই ব্যবহৃত। অথবা বলা যায় ভাষায় সারল্য বেশি, বিভিন্ন কালের অর্থ বোঝাতে একই রকম ক্রিয়াবিভক্তি।

. সবচেয়ে বেশি পার্থক্য এসেছে শব্দ ব্যবহারে। পূর্বোক্ত অন্য পার্থক্যের অনেক কিছু শুধু মুখের কথায় সীমাবদ্ধ হলেও শব্দ-ঘটিত স্বাতন্ত্র্য লেখাতেও জেঁকে বসেছে। পানি, গোস্ত, নাস্তা, গোসল, আপা, বুয়া, দুলা ভাই, চাচা, চাচী, ফুফা, ফুফু, নানা, নানী, কলমা, ফজর, দাদী, আম্মা, আব্বা, মুরিদ, গায়েবী, বুজুর্গ, জঙ্গ, দোয়াএরকম কয়েক শব্দের, আন্দাজ হাজার দুয়েক হতে পারে যা বাংলা অভিধানের অন্তর্ভুক্ত হলেও কলকাতা চলিতে থাকে না বা দু একটি ক্বচিৎ থাকে। এদেশে মুসলমান সমাজে এদের কিছু কিছু ব্যবহৃত হয়ে থাকে, কিন্তু মুসলমান লেখকও সমাজে বা লেখায় তাদের বিশেষ আনেন না। বাংলাদেশের হিন্দুরাও ঠিক তেমনি সমাজে পানি বলে বাড়িতে এসে জলই খায়, হোটেলে গোস্ত অর্ডার দিলেও ঘরে মাংসই পছন্দ করে। ওদেশে মুসলিম প্রাধান্যের জন্য সব ব্যবহার্য ক্ষেত্রে এরূপ প্রচুর শব্দ এসেছে, লেখাও এই সব শব্দের অধিকারে। এরা এসে যাচ্ছে ঢাকাই চলিতে। বাংলা সাধু গদ্যে বা কলকাতা-চলিতে এদের অব্যবহারকে হিন্দুয়ানি বলে অভিযোগ করা যায়। তবে তার পিছনে ছিল সাহিত্যজগতে হিন্দুর একচেটিয়া কর্তৃত্ব। আজ ঢাকাই চলিতও মুসলমানী প্রভাবে জাতীয় শব্দসম্ভারে পূর্ণ হয়ে উঠছে। অবশ্য মুসলমান ধর্ম ধর্মাচার সংক্রান্ত শব্দাবলী কলকাতা চলিতেও প্রয়োজনে ব্যবহৃত। আল্লার কৃপা, হায় খোদা, নামাজ, রোজা, ইফতার প্রভৃতি শব্দ নিয়ে সমস্যা নেই, কিন্তু 'দেশের পানি সম্পদ' বা 'পাঠশালার শিশুদের নাস্তা প্রকল্প' বললে তাকে ঠিক আমাদের ভাষা বলে মনে হবে না। আমি ভালমন্দের প্রশ্ন তুলছি না, এমন কি বোধগম্যতার প্রশ্নও আনছি না। দেখাচ্ছি একটা সুস্পষ্ট পার্থক্য, কিভাবে দাঁড়িয়ে গেছে এবং ব্যাপকতর হচ্ছে।

. আরবি-ফারসি, মুসলমানি শব্দ ছাড়াও অজস্র পূর্ব উত্তর বঙ্গীয় আঞ্চলিক শব্দ আছে, কিংবা সর্বপরিচিত শব্দের আঞ্চলিক অর্থে ব্যবহার আছে যা এই চলিতভাষার নিজস্বতা চিহ্নিত করবে। কামকাজের বদলে, বাসাবাড়ি অর্থে, জামাইশুধু মেয়ের বর অর্থে নয়, শুধু বর অর্থেও, পোলাছেলে, পোনা মাছের চারা অর্থে, ইচাচিংড়ি, পাতারিছোট ভেটকি, কোরালবড় ভেটকি, গায়কগান বানায় গান গায় যে গুণী। চার-বাঁশ দিয়ে তৈরি পোল, চেংড়া, ছেমরাছোকরা। খোঁজা খুঁজি না করে যেমন মনে এল লিখলাম। এরকম শব্দেরও এক লম্বা ফর্দ করা যায়।

. বিশিষ্ট অর্থে পদের ব্যবহার, যা প্রায় ইডিওমেটিক হয়ে ওঠে এবং প্রবাদ-প্রবচনবাংলাভাষার বড় সম্পদ। চলিতেই তার ব্যবহার জুৎসই এবং জোরাল। এগুলি আঞ্চলিক প্রয়োগের স্তর থেকে সর্বজনীনতায় চলে আসে। পূর্ববঙ্গে এই শ্রেণীর শব্দ শব্দগুচ্ছ নিজ চৌহদ্দীর মধ্য থেকে সংকলিত হবে। যেমন, পশ্চিমবঙ্গে সংগৃহীত হবে নিজের অঞ্চল থেকে। এর ফলে স্বাতন্ত্র্য বেড়েই যাবে।

. আরও কিছু বিশিষ্ট প্রয়োগের কথা মনে পড়ছে। বাংলাদেশে 'আগামীতে আমরা আরও চেষ্টা করব, 'পরবর্তীতেএরকম আমরা করি না। প্রেম-ভালবাসা, বই-পুস্তক জাতীয় জোড়বাঁধা শব্দ আমরা ক্রমে কম বলছি, ওদেশে খুব বেশি বলা হয়। আমরা সাধারণভাবে ইংরেজি শব্দ যত ব্যবহার করি বাংলাদেশে তা করে না, বাংলা শব্দ সেখানে সহজেই বসিয়ে দেয়। আমরা ইলেকট্রিকের বিল দিই, ওরা দিয় বিদ্যুতের। আমরা ইউনিভারসিটিতে পড়াই, ওরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আবার আমরা যাকে হস্টেল বলি, ওরা বলে হল। আমরা আদিখ্যেতা বলি, ওরা বলে আহ্লাদি সঙ্গে পনা থাকলে অতটা চমকাতাম না। চিন্তাশীলেরা ভেবে দেখবেন। আরও প্রচুর উদাহরণ জোগাড় করা যেত, তার জন্য গুটি কয় গবেষককে নিয়ে লেগে পড়া দরকার ছিল।

. ঢাকাই চলিতকে কিন্তু কলকাতাই চলিতের কিছু বৈশিষ্ট্য সহজাতভাবেই আত্মসাৎ করতে হবে। কারণ ভাষাশ্রয়ী সাহিত্য ওদেরও দীর্ঘকালীন ঐতিহ্য ছিল, এখনও চর্চা আছে।

কিন্তু এইসব বৈশিষ্ট্য একটা শৃঙ্খলাবদ্ধ আকার নেবে যখন লেখায় ব্যাপকভাবে এই ভাষার ব্যবহার হবে। তখন ঠিক এরকমটাই হয়ত থাকবে না, একটা সচেতন স্ট্যান্ডার্ডাইজেসনের পথ ধরে এগোবে। আর সেই রীতিও বহু লেখকের বিভিন্ন মেজাজ বিশ্বাস অনুযায়ী বিচিত্র হয়ে উঠবে, ঢাকাই চলিত পূর্ণাঙ্গ শিল্পশোভন রূপ লাভ করবে তাতে দুই বঙ্গের দুই রকম চলিত ভাষা প্রচলনের ফলে আমাদের দু-দেশের ভাষা কিন্তু একে অপরের অপরিচিত হয়ে পড়বে না। কোথাও কখনও বোঝা না বোঝার কিছু স্বচ্ছ পর্দা ঝুলবে যা অচিরে উত্তোলিতও হবে; বড় জোর একটু আলাদা। বাংলাদেশী রঙেরসে ওদের রচনা আমরা উপভোগ করব।

 

রেফারেন্স তথ্যসূএ :

Ø Viper Island-The Pharos of Indian Penal Settlement By Gauri Shankar Pandey, Sangeeta Publishing House, 1997, pp. 3.6, 14, 16, 27, 28, 29, and

Ø The Cellular Jail, the national memorial. By G. S. Pandey, Port Blair, 1987 and 1997.

Ø Unsung Heroes of Freedom Struggle in Andamans / Part-II / who's who / compiled & Edited by Rashida Iqbal. published by Directorate of Educa tion and Culture, A. & N. Administration., pp-34, 76, 77, 78,

Ø The Mazar at South Point... [Article] By Sayed Shaukat Ali. Ibid. Kalapani, Dr. L.P. Mathur. VIII Chapter, 1985, pp. 73, 74.

Ø The Penal Settlement in Andamans, Dr. R. C. Majumdar.

Ø The Andaman Story, N. Iqbal Singh.

Ø অন্ধকারের আন্দামানে, . আশুতোষ ভট্টাচার্য।

Ø মুক্তিতীর্থ আন্দামান, গণেশ ঘোষ, ১৯৮২, পৃ. ,

Ø যাতনাভূমি অন্তমান কা রোমাঞ্চকর ইতিহাস, চিন্তামণি শুরু, ১৯৮৫, পৃ. ২১। তারিখ--আজীব-কালাপানি, মুহম্মদ জাফর থানেশ্বরী লেখক কর্তৃক ক্ষেত্র-সমীক্ষা।

Ø আই, এইচ খান, আই. এফ. এস, কনজারভেটর অফ ফরেস্ট: বনসদন: পোর্ট ব্লেয়ার।

Ø এম. . লতিফ, সেক্রেটারি, আন্দামান-নিকোবর রাজ্য ওয়াক্ফ বোর্ড।

Ø রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডের কর্মীবৃন্দ। ইমাম, মাজার শরীফ, সাউথ পয়েন্ট।সংকলক : বিজনকুমার মণ্ডল



No comments: